টাঙ্গাইলে কাজ সম্পন্ন না করেই সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ঠিকাদারদের প্রায় ৫ কোটি টাকার অগ্রিম বিল পরিশোধ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ফরিদপুরের ঠিকাদার জিন্নাত হোসেন বিশ্বাস একাই পেয়েছেন প্রায় ৪ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, টাঙ্গাইল সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সিনথিয়া আজমিরী খান এবং টাঙ্গাইলের স্থানীয় দুই ঠিকাদার সুমন ও মনোজ খানসহ (যারা জেলা সওজের তথাকথিত ‘সিন্ডিকেটের মূল হোতা’ হিসেবে পরিচিত) আরও একজন।
তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সজিব বলেন, আমাদের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে টাঙ্গাইলের সুমন ও মনোজ কাজ করেন। অফিসিয়াল দিকটা তারাই দেখাশোনা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সওজ টাঙ্গাইল অফিসের আওতায় ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বাউশি–গোপালপুর সড়ক সংস্কারের কাজ পান ফরিদপুরের জিন্নাত হোসেন বিশ্বাস। কিন্তু কাজ শুরু না করেই ২৩ জুন কাজ শেষ দেখানো হয় এবং নির্বাহী প্রকৌশলী সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করেন।
এরপর ১ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ সমাপ্তির সনদপত্র (স্মারক নম্বর ৪৭৪.৯৯.০০৯.২৫-৩৯৮) প্রদান করা হয়। অথচ ওই সড়কে প্রকৃতপক্ষে কোনো সংস্কার কাজই হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার গোপালপুর-বাউশি সড়কে সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের পাশে কয়েকজন শ্রমিক আগাছা পরিষ্কারের কাজ করছেন। শ্রমিকরা জানান, তারা বুধবার থেকে কাজ শুরু করেছেন।
সড়কে কাজ করা শ্রমিক সুরুজ আলী খান বলেন, বুধবার থেকে আমরা কাজ করছি, কিন্তু ঠিকাদার কে, সেটা জানি না। এ সময় শাহীন নামের এক ব্যক্তি এসে শ্রমিকদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, এই সড়কে গত ১০–১২ বছরে কোনো সংস্কার কাজ হয়নি। তবে গত দুইদিন ধরে কিছু শ্রমিক সড়কের ধারে ঘাস-মাটি পরিষ্কার করছে।
পানতারা গ্রামের আব্দুল হাই আকন্দ বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে এখানে কোনো কাজ হয়নি। কিছু জায়গায় গর্ত হয়েছে, কিন্তু সেগুলোও কেউ ঠিক করেনি। এখন হঠাৎ শ্রমিকেরা এসেছে।
একই ধরনের অনিয়ম দেখা গেছে এলাসিন–দেলদুয়ার, মধুপুর–কালিহাতী এবং মির্জাপুর–করটিয়া বাইপাস সড়কের সংস্কার প্রকল্পেও। এলাসিন–দেলদুয়ার সড়কে কোনো কাজ না করেই জিন্নাত হোসেন বিশ্বাসের নামে ৮৮ লাখ টাকা বিল তোলা হয়েছে। মধুপুর–কালিহাতী সড়কে ৯০ লাখ টাকা বিল তোলা হয়েছে কাজ ছাড়াই। মির্জাপুর–করটিয়া বাইপাস সড়কের স্লোপ ড্রেনের কাজ ছাড়াই বিল হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। মির্জাপুর সড়কে সিলকোট কাজ না করেও হাসমত ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৬০ লাখ টাকা। সব কটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন টাঙ্গাইলের সুমন ও মনোজ নামের দুই ঠিকাদার।
এছাড়া পাথর ও ইট সরবরাহ না করেও তিন ধাপে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১৮ লাখ, ১২ লাখ এবং ২৯ লাখ টাকা। পুরাতন মালামাল বিক্রির নামে আত্মসাৎ হয়েছে টাঙ্গাইলে ২২ লাখ, মির্জাপুরে ২৫ লাখ, মধুপুরে ১৭ লাখ টাকা। কর্মকর্তাদের দাবি ‘বরাদ্দ ফেরত না দিতে কাজ সম্পন্ন দেখানো হয়’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে জুন মাসে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বিল না তুললে বরাদ্দ ফেরত চলে যেত। তাই নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া আজমিরী খান জুন মাসে কাজগুলো সম্পন্ন দেখিয়ে বিলগুলো উঠিয়ে রেখেছে। এখন পর্যায়ক্রমে ঠিকাদাররা কাজ শুরু করবে।
মধুপুর সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সোহেল মাহমুদ বলেন, জুনে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছিল, যাতে বরাদ্দ ফেরত না যায়। এখন ঠিকাদাররা সেই কাজগুলো শুরু করবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুজন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মূলত লাইসেন্স ভাড়া দিই। যারা লাইসেন্স নেয়, তারাই অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরা মাঠের কাজ তদারকি করি না। অফিস কেন কাজ বুঝে না নিয়ে বিল দিয়েছে, সেটা আমরা জানি না।
টাঙ্গাইল সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সিনথিয়া আজমিরী খান বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া অন্যদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
এমজে