নাটোরের বাগাতিপাড়ায় মো. সোহেল রানা নামে দরিদ্র এক কৃষকের চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা একটি গাভি বিষক্রিয়ায় মারা যাওয়ার ঘটনায় ময়নাতদন্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করেছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। একই সঙ্গে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ঘাসে বিষ দিয়ে গাভি মেরে ফেলার অভিযোগ এনে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন কৃষক।
শুক্রবার (২২ আগস্ট) বিকেলে উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের দোবিলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী সোহেল রানা ওই গ্রামের বাসিন্দা। গত ১৯ আগস্ট দুপুরে লিজ নেওয়া জমিতে তার চাষ করা ঘাস কাটার পর গরুকে খাওয়ানো হয়। সন্ধ্যার দিকে গাভিটির পেট ফেঁপে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনদিন চিকিৎসার পর ২২ আগস্ট বিকেলে মারা যায় গাভিটি।
কৃষক সোহেল রানা জানান, জীবিকার জন্য ভরসা রেখেছিলেন একটি গাভির ওপর। শুধু দুধ বিক্রিই নয়, গাভিটি ছিল তার সংসারের একমাত্র সম্বল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই গাভি মারা যাওয়ায় পথে বসার শঙ্কায় পড়েছেন তিনি। অভিযোগ, প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের দেওয়া ঘাসে বিষ মেশানো ছিল বলেই প্রাণ গেছে তার গাভির। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, দিনমজুরির পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে অন্যের জমি লিজ নিয়ে নেপিয়ার ঘাস চাষ করতেন। প্রতিবছর নির্ধারিত ৫ হাজার টাকা ভাড়াও নিয়মিত দিতেন। কিন্তু গত ১৯ আগস্ট দুপুরে তার লাগানো ঘাস কাটার পর থেকে বিপত্তি শুরু হয়। সেদিন সন্ধ্যায় গাভির পেট ফেঁপে ওঠে ও দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিন দিন চিকিৎসার পর ২২ আগস্ট বিকেলে মারা যায় গাভিটি।
তিনি জানান, গাভিটি চার মাসের গর্ভবতী ছিল। একে শুধু গাভি নয়, ভবিষ্যতের বাছুরটিও হারাতে হয়েছে তাকে। আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। সোহেল রানা বলেন, আমি তো একেবারে গরিব মানুষ। সংসারে আয়-রোজগারের ভরসা ছিল এই গাভিটিই। এখন একেবারে পথে বসে গেছি। আসামিপক্ষ অনেক বড়লোক, তাদের সঙ্গে লড়াই করে আমি কি সঠিক বিচার পাব? এ ঘটনায় শুক্রবার (২২ আগস্ট) রাতেই তিনি বাগাতিপাড়া মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযুক্তরা হলেন- উপজেলার দোবিলা এলাকার আজিজ মণ্ডলের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা, মৃত আব্বাস আলীর ছেলে মোহাইমিনুল হক মিঠু এবং কৈপুকুরিয়া এলাকার বাহার উদ্দিন বারুর ছেলে লুৎফর আলী।
সোহেল রানা অভিযোগ করেন, তাদের হুকুমে তার লাগানো নেপিয়ার ঘাসে ঘাসমারা ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। আর সেই বিষাক্ত ঘাস খেয়েই মারা গেছে তার গাভি।
এ বিষয়ে বাগাতিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
বাগাতিপাড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু হায়দার বলেন, মৃত গাভির ময়নাতদন্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা ঢাকায় পাঠানো হবে। চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মেহেরুন্নেসা জেলা জজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে সাংবাদিককে বলেন, পুলিশ এসেছিল, আপনারা পুলিশের থেকে জেনে নিন ঘটনা কী। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত মোহাইমিনুল হক মিঠুর মোবাইলফোনে একাধিকবার কল করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
অভিযুক্ত লুৎফর আলী বলেন, জমির মালিক মেহেরুন্নেসা আমার বিয়ান। তিনি আমাকে বলেন কাজের লোক ঠিক করে দিতে জমিতে ঘাসমারা বিষ দেওয়ার জন্য। পরে আমি লোক ঠিক করে দিয়েছি এবং তারা গিয়ে জমিতে বিষ দিয়েছে। আমি এতটুকুই জানি।
ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী বলেন, জমিতে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল এবং সেই জমির ঘাস খেয়েই গাভিটি মারা গেছে। গরুর মালিক সোহেল খুব দরিদ্র মানুষ। গরুটি মারা যাওয়ায় তিনি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
এদিকে স্থানীয়ভাবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, নাটোরে এর আগে কখনও গাভির ময়নাতদন্ত হয়েছে কিনা। কৃষক সমাজের একাংশ বলছে, গাভির ময়নাতদন্ত বিষয়টি সচরাচর শোনা যায় না। তাই এবার প্রাণিসম্পদ বিভাগের এই পদক্ষেপ আলোচনায় এসেছে।
আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনায় প্রাণিসম্পদ বিভাগের রিপোর্ট মামলার প্রমাণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কারও দায় চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা যাবে না।
সোহেল রানার এখন কেবলই আফসোস— যা গেল তা আর ফেরত পাব না। আমার ক্ষতি পূরণের জন্য কেউ নেই। এখন শুধু চাই, এই অন্যায়কারীর যেন বিচার হয়।
এসআরএস