টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টানা দুইদিন বিপৎসীমার ওপরে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহে চরম অবনতি ঘটেছে লালমনিরহাটের বন্যার পরিস্থিতি।
বুধবার (১৩ আগস্ট) বিকেল ৩টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১৯ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ৪ সেন্টিমিটার ওপরে। দিনভর বিপৎসীমার ৭ থেকে ৪ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়।
নদীপাড়ের মানুষ ও বন্যা সতর্কিকরণ কেন্দ্র জানায়, কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ সোমবার রাত থেকে বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা ও ৯টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচে।
দুপুর ১২টায় আরও বেড়ে তা বিপৎসীমা অতিক্রম করে দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পরদিন বুধবার আরও বেড়ে যায় পানি প্রবাহ। ডালিয়া পয়েন্টে দিনভর ৭ থেকে ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে তিস্তা নদীর উভয় পাড়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
তিস্তার পানি বাড়ার ফলে লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার বেশ কিছু অংশ বন্যায় ডুবেছে। এর মধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, পলাশী এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
টানা দুই দিনের বন্যায় পানিবন্দি পরিবারগুলো চরম দুর্ভোগে পড়েছে। গবাদি পশুপাখি, বৃদ্ধ শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ঘরের ভেতর বিছানায় মাচাং বানিয়ে সারাদিনের রান্না একবারে করছেন গৃহকর্মীরা। কেউ কেউ পাশের উঁচু রাস্তা বাঁধে চুলা বসিয়ে রান্না করে নিচ্ছেন। বাঁধ আর রাস্তার ধারে পলিথিনের তাবু সাটিয়ে রাখা হচ্ছে সন্তানতুল্য গবাদি পশুগুলোকে। সব চেয়ে বড় বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি পরিবারের নারীরা। পায়খানা ডুবে যাওয়ায় শৌচ কাজ সাড়তে বেশ বিড়ম্বনায় পড়ছেন নারীরা। প্রায় সব বাড়ির টিউবয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানিরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
তিস্তাপাড়ের গোবর্দ্ধন গ্রামের আজিজার রহমান বলেন, দুইদিন ধরে চরাঞ্চলের প্রায় বাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির কারণে সাপ, পোকামাকড়ের উপদ্রুত বেড়েছে। গরু ছাগলের খাদ্য ও রাখার মতো শুকনো জায়গা মিলছে না। পানিতে রাখলে গরু ছাগল তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাহিরে রাস্তায় রাখলে চুরি হওয়ার ভয় থাকে।
উত্তর ডাউয়ামারী গ্রামের জুয়েল জানান, রাস্তা ঘাট ডুবে গেছে। আমাদের গ্রামের সব বাড়িতে হাঁটু বা কোমড় পানি। রান্না করা খাওয়া, থাকা, প্রস্রাব পায়খানা করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রাতে ঘুমাতে পারিনি। কখন যে পানিতে কে পড়ে যায়? আতঙ্কে থাকি বাচ্চাদের নিয়ে। নিদারুন কষ্ট আমাদের ভাই।
ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজারের বেশি পরিবার টানা দুইদিন ধরে পানিবন্দি রয়েছে। তাদের তালিকার পাশাপাশি খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার দুইদিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের তালিকা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে। দুইদিন ধরে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তাপাড়ের নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলায় ৪০ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। উজানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার দরুন পানির চাপ কিছুটা বেশি। বন্যার উন্নতি হতে কিছুটা সময় লাগবে। তাই এসব অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। বুধবার বিকেল ৩টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। আমরা সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে কিছু প্যাকেটজাত শুকনো খাবার ও জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, খুব দ্রুত বিতরণ করা হবে। আরও কিছু শুকনো খাবারের জন্য বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
আরএ