ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

সাদাপাথরে যৌথবাহিনী মোতায়েনসহ ৫ সিদ্ধান্ত সিলেট জেলা প্রশাসনের

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:৪৮, আগস্ট ১৪, ২০২৫
সাদাপাথরে যৌথবাহিনী মোতায়েনসহ ৫ সিদ্ধান্ত সিলেট জেলা প্রশাসনের সাদাপাথর লুট

নজিরবিহীন লুটপাটের পর এবার সাদাপাথর রক্ষায় টনক নড়লো প্রশাসনের। সিলেট জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় পাথর লুটপাট ঠেকানো ও লুটের পাথর সাদাপাথরে পুনঃস্থাপনে ৫ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

  
 
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
 
এর আগে বুধবার (১৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় সিলেট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউজে সর্বস্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
সিদ্ধান্তগুলো মধ্যে- জাফলং ইসিএ এলাকা ও সাদা পাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।  

গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের চেকপোস্ট যৌথ বাহিনীসহ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে।  

অবৈধ ক্রাশিং মেশিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ বন্ধ করার জন্য অভিযান চলমান থাকবে।  

পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।  

চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে।
 
গত দুই সপ্তাহে সিলেটের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে নজিরবিহীন লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সীমান্তের জিরো লাইন সংলগ্ন ১০ নম্বর এলাকার ‘সাদাপাথর’ সব পাথর নিয়ে যায় লুটেরার দল। অথচ পাথর উত্তোলনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে লাগামহীন লুটপাটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সাদাপাথর এখন বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। একইভাবে সিলেটের জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকা থেকেও বালু-পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকে।
 
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়ে সরকারের কাছে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার জন্য বারবার দাবি জানায়।

এ দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করে জামায়াত, বিএনপি, এনসিপি, চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করিমসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল।
 
সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন দাবিতে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন এমনকি  ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। এসব সভা-সমাবেশ মানববন্ধনে নিজেদের বুদ্ধিভিত্তিক নানা খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরে তারা বলেন, ‘ভারতের স্বার্থে বিগত সরকার পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখে- এমন অভিযোগ ছিল আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর। তাছাড়া সরকারের ওপর মহলকে ধরাশায়ী করতে ‘পাথর উত্তোলন না করায় সিলেটে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে’- এমন খোঁড়া যুক্তিও তুলে ধরেন। পক্ষান্তরে এসব দাবির আড়ালে স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার সুযোগে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ‘পাথর খেকোচক্র’ রাতের আঁধারে এমনকি প্রকাশ্যে সাদাপাথর লুট করে নেন। পাথর লুটের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
 
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও হতাশা প্রকাশ করে বলেন- ‘চার বছর পরিবেশকর্মী হিসেবে সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছি, এখন উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না। ’
 
এসব ঘটনার পর টনক নড়ে সিলেটের প্রশাসনের। মঙ্গলবার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। বুধবার বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন এতোদিন নীরব থাকা বিভিন্ন সামাজিক সুশীলসমাজসহ পরিবেশবাদী সংগঠন। একই দিন দুদকের একটি টিম প্রধান কার্যালয়ের সিলেট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক রাফী মোহাম্মদ নাজমূস সাদাতের নেতৃত্বে সাদাপাথর এলাকার লুটপাটের চিত্র দেখতে সরেজমিন ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর এলাকায় যান।  

তদন্ত শেষে দুদক কর্মকর্তারা জানান, সাদাপাথরে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এতে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ও স্থানীয়রা এবং প্রশাসনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে, মনে করছেন। তবে তদন্ত শেষে  জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
 
দেরিতে অভিযান পরিচালনার বিষয়ে দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, সিলেট থেকে ভৌগলিক দূরত্বের কারণে দেরিতে অভিযান চালানো হয়েছে। এটা ভৌগলিক দিক থেকে স্থানীয় প্রশাসনের অনেক কাছে। স্থানীয় প্রশাসনের আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল।
 
দুদক কর্মকর্তারা আরও বলেন, সাদাপাথর লুটপাটের বিষয়টি সারা দেশে ভাইরাল হয়েছে। বাস্তব অর্থে আমরা এখানে এসে তাই দেখলাম-সব পাথর লুটপাট করে নিয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে জানতে পারলাম, প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এখানে পাথর লুটপাট করেছে। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন জড়িত আছে, প্রশাসনেরও ভূমিকা আছে। পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন আছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাছেই বিজিবি ক্যাম্প আছে। দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন-বিজিবি ক্যাম্প থাকার পরও রাতদিন ২৪ ঘণ্টা ৫০ হাজার মানুষ পাথর লুট করছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার নৌকা এসে পাথর লুট করে। প্রতিটা নৌকায় ১০/১২ জন মানুষ থাকে। এতো এতো মানুষ গত এক বছর ধরে পাথর লুট করছে, তাহলে আর কিছু থাকে।
 
দুদক কর্মকর্তারা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন, শুনেছেন, অনেকের নাম পেয়েছেন, যারা এই পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত। এই ব্যক্তিগুলো ছাড়াও প্রশাসনের দায়বদ্ধতাও দেখা হবে বলে জানান তারা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিলের পর পরবর্তী নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করা হবে। তাছাড়া স্পেশালিস্ট কোনো টিম আসলে দেখা যেত কত টাকার পাথর লুট হয়েছে। তবে কোটি কোটি টাকার তো হবেই।
 
স্থানীয়রা জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে শুরু হয় আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ থাকা পাথররাজ্যে লুটপাট। শাহ ভোলাগঞ্জের আরেফিন টিলা, রোপওয়ে বাংকার থেকে প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন করে এখন ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 
এনইউ/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।