বরিশাল: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকেই ঢাকার কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বরিশালের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও শিক্ষাঙ্গনসহ রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু করে।
শুরু থেকেই বরিশালের আন্দোলনে রাজপথে থেকেছেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাহিদ ইসলাম। বরিশাল শহরের বাসিন্দা না হলেও গোটা আন্দোলনের সময় তিনি এখানে থেকেছেন। সহযোদ্ধাসহ বন্ধুরাই তাকে বরিশালে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।
এর মাঝেই তিনি হামলার শিকার হয়েছেন একাধিকবার, প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছেন অনেকভাবে। তারপরও তাকে দমাতে পারেনি তৎকালীন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ক্যাডারসহ নিরাপত্তা বাহিনী। ৫ আগস্টের বিজয় নাহিদ উদযাপন করেছেন বরিশালের মাটিতেই।
সেদিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে এ জুলাইযোদ্ধা বাংলানিউজকে বলেন, জুলাইয়ের যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল, সেসময় আমি বরিশালে একজন সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছি। কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন সরকারি দলের সন্ত্রাসী বাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সাধারণ জনগণের দীর্ঘ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এখানে হয়েছিল, আর সেখান থেকেই বলা হয় গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল, একটি নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে।
তিনি জানান, বরিশালে প্রথম আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে ২০২৪ সালের ৯ জুন। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, সরকারি বরিশাল কলেজ, ইসলামীয়া কলেজ, সরকারি পলিটেকনিক কলেজ, জিলা স্কুলসহ সরকারি-বেসরকারি স্কুলকলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও যুক্ত হন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমাতে চেষ্টা করে, তাই শুরুর দিকে অনেক কর্মসূচিতেই বিপুল সংখ্যক জমায়েত ঘটানো সম্ভব হতো না। তবে জুলাইয়ে এসে এর প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন ঘটে এবং ১৬ জুলাই সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে ছাত্রলীগকে উৎখাত করা হয়। পাশাপাশি বরিশালে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীরা। আর আন্দোলনটি ধীরে ধীরে গেরিলা কায়দায় সংগঠিত হতে শুরু করে।
১৭ জুলাই বরিশালে সবচেয়ে জোরালো আন্দোলনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে চৌমাথা ও নথুল্লাবাদে তৎকালীন সরকারের পুলিশ লীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সন্ত্রাসী বাহিনী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে মাঠে নামে, যা প্রতিহত করতে গিয়ে অনেক আন্দোলনকারী হামলার শিকার হন এবং কারাগারে যান। এরপর থেকে কারফিউ জারি হলে আন্দোলনে কিছুটা ধীরগতি দেখা দেয়। তবে ২৯ জুলাই থেকে আবার আন্দোলন রাজপথে দানা বাঁধতে শুরু করে। ৩১ জুলাই সদর রোডে শিক্ষার্থীদের মার্চ ফর জাস্টিস আন্দোলন কর্মসূচিতে পুলিশ নির্মমভাবে হামলা করে। এরপর ধারাবাহিক কর্মসূচিতে আগস্টের ২ তারিখ থেকে বরিশালে গণজোয়ার শুরু হয়, লাখ লাখ মানুষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নেমে আসে এবং এতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বরিশাল ছাড়তে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট জালিম সরকারের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করি।
নিজের আহত হওয়ার কথা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, জুলাই আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় আমিসহ বরিশালে ছেলে-মেয়েসহ অনেক সহযোদ্ধা আহত হয়েছেন। বরিশালের অনেক সন্তান ঢাকার রাজপথে শহীদ হয়েছেন, আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কিন্তু আহত হওয়ার পরেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানো যায়নি, আহত অবস্থাতেই সবাই আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য রাজপথে ছিল।
তিনি বলেন, বরিশালে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রশাসনের থেকেও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দিক থেকে ভয়ে বেশি ছিল আন্দোলনকারীরা। তারা অস্ত্র নিয়ে সড়কে মহড়া দেওয়াসহ আন্দোলনকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও হুমকি দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের অনেককে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল, আমাকেও পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে আটকে রাখে এবং বরিশাল ত্যাগ করতে বলেছিল। তবে আন্দোলনকারীরা অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টার চেয়েও বেশি অনড় থেকে মরণ-প্রাণ লড়াই করেছে।
অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, আগস্টে সরকার গঠনের পর সেটি আর আমরা দেখছি না। জাতীয় ঐক্য না হলে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুযোগ নেবে আবার। আমাদের পূর্বপূরুষরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে হোঁচট খেয়েছে, জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। তারই ধারাবাহিকতায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমরা সৃষ্টি করেছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং দলমত নির্বিশেষে ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ হিসেবে সবার অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা ২৩ বছরের করুণ নিপীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে সংগ্রাম করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি। আমার থেকে আমার সহযোদ্ধাদের ত্যাগ অনেক, কারণ তাদের কেউ চোখ হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, নয়তো শহীদ হয়েছে।
আন্দোলনে সফল শিক্ষার্থীরা বরিশাল থেকে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে এই সংগঠক বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে না দিয়ে তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। বরিশালে আওয়ামী লীগের সাদিক আব্দুল্লাহ, তার সহযোগী রইজ আহম্মেদ মান্নার মতো ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি, যারা কিনা নারী সহযোদ্ধাসহ আমাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। আবার দেখুন কোর্টে গিয়ে আওয়ামী লীগের দোসররা স্লোগান দেয় এখনো, এটাও দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আজ ফ্যাসিবাদের স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটাও দুঃখজনক। এটাও আওয়ামী লীগের কারণেই হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা কাউকে আক্রমণ করতে চাই না, তবে ফ্যাসিবাদ ও তার দোসরদের বিচার চাই। অভ্যুত্থান ছিল সবার অধিকার রক্ষার জন্য, এখানে কাউকে ট্যাগ দিয়ে সমাজ থেকে বা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই। এটি যেহেতু স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সেখানে যে কেউ তার মত প্রকাশ করতেই পারে। মত প্রকাশ করতে না পারলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। কেউ মত প্রকাশ করলে সেই মতের বিরুদ্ধে ভিন্ন আইডোলজিক্যাল চিন্তা প্রয়োজনে দাঁড় করাবো, কিন্তু কাউকে আক্রমণ করা যাবে না।
এমএস/এইচএ/