আর এক সপ্তাহ পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছর দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন হয়েছে।
প্রশ্ন : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
উত্তর : দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে নিষ্পেষিত জনগণের ধারাবাহিক আন্দোলনের একটি সফল পরিণতি হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। গণতান্ত্রিক এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাংবাদিকসহ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান ছিল এই আন্দোলনে। জনগণ দীর্ঘদিন ধরে অধিকারবঞ্চিত, নিষ্পেষিত ও নিগৃহীত ছিল।
অধিকারহারা মানুষকে নিয়ে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ‘আমি ডামি’ নির্বাচনের অনেক আগেই রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিবাদবিরোধী এক দফার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। সেই এক দফা ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফলতা লাভ করে। এই গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ছিল মূলত অধিকার আদায়ের। সেটি গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অধিকারসহ নানা নাগরিক অধিকার।
এটি পাহাড়সম প্রত্যাশা। এসব হারানো অধিকার এক দিনে বা এক বছরের মধ্যে পেতে চাইলে সেই প্রত্যাশা মনে হয় একটু বেশি হবে। তবে দেশের মানুষের আশা ছিল, এই প্রত্যাশা পূরণের সূচনা এক বছরের মধ্যে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আশানুরূপ সূচনা করতে পারেনি।
প্রশ্ন : কেন পারেনি?
উত্তর : সরকার জন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সরকার গঠনের মধ্যেই আমরা নানা অসংগতি দেখলাম। যেসব ব্যক্তিকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তাঁদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব আছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব দেশে ছিল না। নিরপেক্ষভাবে যে সরকার গঠন করা হয়নি, সেই অভিযোগ উঠেছে।
প্রধান উপদেষ্টা উপযুক্ত দল নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেননি। যার কারণে সরকার গঠনের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। স্বাস্থ্য সেক্টরে কোনো ধরনের নিয়মের বালাই নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে জায়গায় আমি মনে করি সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। মোদ্দাকথা, কোনো সেক্টরেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। উপদেষ্টাদের অনভিজ্ঞতার কারণে তাঁরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। এখন সবারই সবকিছু জানা-বোঝা হয়ে গেছে। আসলে রাষ্ট্র কোনো খেলার মাঠ নয়। আরেকটু বেশি করে বলতে গেলে, এটা বাচ্চাদের খেলার মাঠ নয়।
প্রশ্ন : কিন্তু সরকার তো সাংবিধানিকভাবেই চলছে?
উত্তর : সাংবিধানিকভাবেই এ সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু সব জায়গায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যে ধরনের কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন এবং যে রকম শক্তিশালী দল নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল, এই সরকার কি তা পেরেছে? এটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তার পরও আমরা সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আমরা সব সময় একটি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করলে দেশে নানা সমস্যা দেখা দেয়; এবং তা-ই এখন দেখা যাচ্ছে। সরকারের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারের বাহানায় নির্বাচন বিলম্ব করলে তাদের একটা সফলতা আসবে।
প্রশ্ন : ঐকমত্য কমিশন তো সংস্কারকাজ শেষ করার জন্য আলোচনা করছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
উত্তর : সংস্কার নিয়ে কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু অনভিজ্ঞতার কারণে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অতীতে সরাসরি অন্তর্ভুক্তি না থাকায় তারা এমন কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক জটিলতা তৈরি করবে।
প্রশ্ন : আপনাদের কারণে সংস্কার প্রক্রিয়া এগোনো যাচ্ছে না—অনেকে এমন অভিযোগ করেছেন। আপনারা কি তাহলে ঐকমত্য কমিশনকে সহযোগিতা করছেন না?
উত্তর : ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে কিছু প্রস্তাব আসছে, যা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তা কতটুকু ভারসাম্য বজায় রাখবে তা তারা বিবেচনায় আনেনি। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল কমিশন। এতে নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ডে নানা রকম হস্তক্ষেপ হবে। তার পরও আমরা বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে ছাড় দিয়ে যাচ্ছি। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই, ঐকমত্য কমিশনে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, রাষ্ট্রে যাতে সাংবিধানিকভাবে কোনো স্বৈরাচারের উৎপত্তি না হয়, ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি না হয়; সেটি বন্ধ করার কয়েকটি কায়দা আছে। এর মধ্যে একটি হলো, কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পাবেন না। এটা আমাদেরই প্রস্তাব। এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যক্তিতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎপত্তি সেখানেই বন্ধ হবে। আরেকটি হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যেন বিলুপ্ত করতে না পারে, সে জন্য গণভোটের প্রস্তাবও আমি নিজেই দিয়েছি। আবার সরকার, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগ মিলে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টিও আনা হলো। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে। এতে নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত থাকবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলে রাষ্ট্রে কোনো সময় স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হবে না। অর্থাৎ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা—তিনটিই নিজ অবস্থানে থেকে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে। এক বিভাগ আরেক বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইবে না। এর মাধ্যমে একটি ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে। এভাবেই আমরা সংস্কারগুলো গ্রহণ করছি।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে। অন্য রাজনৈতিক দল, অংশীজনদের ওপর আপনি কতখানি আশাবাদী?
উত্তর : সব গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তি তাদের নিজস্ব আদর্শ অনুযায়ী প্রস্তাব দিয়ে থাকে। কিন্তু সবাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের চাহিদাকে প্রাধান্য দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আমাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেক সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনেক বিষয়ে ছাড় দিচ্ছি। দেশ ও জনগণের স্বার্থে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করছি। সবার আগে বাংলাদেশ—এটাই আমাদের নীতি। আমরা চাই, একটা কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক তিক্ত। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কাজ করছি, যাতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয়।
প্রশ্ন : সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। মানুষ জানতে চায় যে নির্বাচন আদৌ হবে কি না। আপনি কী মনে করেন?
উত্তর : মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এখন পর্যন্ত লন্ডন বৈঠকের ভিত্তিতে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট মাস ও দিন-তারিখ উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনকে বার্তা দেননি। এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে আমি আশা করি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে, ৫ আগস্টের আগে, অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির আগেই তিনি বিষয়টি জাতির সামনে পরিষ্কার করবেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে তাঁর বার্তা দেবেন। এটি হলে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। আমি আশা করি, এবারের নির্বাচন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যাতে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের নির্বাচনকে অনুসরণ করে। এ জন্য আমরা বারবার অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষতা প্রদর্শনের পরামর্শ দিচ্ছি। পরবর্তী নির্বাচনে যাতে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে পারে, সেই কথা বারবার বলছি। তা না হলে জনমনে প্রশ্ন থেকে যাবে। সুনির্দিষ্ট একটি দলকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার যে প্রশ্নটা মানুষের মনের মধ্যে আছে, সেটা সত্য মনে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো, শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেগুলো করতে হয়, সরকার যেন সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করে।
প্রশ্ন : তাহলে সংস্কার ও বিচার কি নির্বাচিত সরকার করবে?
উত্তর : সংস্কার ও বিচারের কাজ তো চলমান থাকবে। এসব তো এক দিনে শেষ হবে না। সংস্কার যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে। এখন আমরা যেটিকে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার মনে করছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও একসময় পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দিই। আমরা উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপনের বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছি। অথচ ১৯৯১ সালে উপজেলা থেকে আমরা আদালত তুলে নিয়েছি। তার মানে, ৩৫ বছর পরে জনগণের মধ্যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তাই এ সংস্কারটা করতে হচ্ছে। যে সংস্কারটা ৩৫ বছর আগে আমরা সঠিক মনে করিনি, তা এখন ঠিক মনে করছি। তবে সব উপজেলায় আদালত হবে না। সদর উপজেলা জেলা জজের আদালতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। যে উপজেলার সঙ্গে জেলার দূরত্ব কম, সেটিও জেলার সঙ্গে থাকতে পারে। আর যেগুলো দ্বীপাঞ্চলে এখন আছে, সেগুলো বহাল থাকবে। ব্রিটিশ আমলের চৌকি যেখানে যেখানে আছে, সেগুলো থাকবে। অর্থাৎ সংস্কার চলমান বিষয়। আর বিচারের জন্য যদি আমরা সময় নির্ধারণ করি, সেটিই হবে অবিচার। বিচারের জন্য আসামিপক্ষকে যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই বিচার সময়সাপেক্ষ বিষয়।
যাঁরা মনে করেন, সংস্কার ও বিচার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে, এটি সঠিক ভাবনা নয়। বিচার চলমান প্রক্রিয়া। যাঁরা গণহত্যার জন্য দায়ী, যাঁরা বিগত ১৬-১৭ বছর গুম, খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তবে পুরো দেশে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সবাইকে এই বিচারপ্রক্রিয়ায় আনতে হলে অনেক বছর লেগে যাবে। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে বিচার-সালিসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বিভক্তি দূর করে সমাজের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, যাতে হিংসা ও বিভক্তি আর না থাকে। কিন্তু সেটা অবশ্যই আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ বিভক্ত সমাজে কখনো জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি হয় না।
প্রশ্ন : আমরা তো দেখছি, এক বছর পার হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ কোনো ভুল স্বীকার করেনি। আপনি কতটা আশাবাদী যে তাদের উপলব্ধি হবে?
উত্তর : আওয়ামী লীগের তো এখন রাজনৈতিক চরিত্র নেই। বহু আগেই তারা রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়েছে। ১৯৭২ সালে তারা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছে, কবর দিয়েছে এবং নিজেরাও দাফন হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ নামে কোনো সংগঠন ছিল না, তা বাকশালে পরিণত হয়েছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে ১৯৭৯ সালের পর আওয়ামী লীগ নামে দলটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। তবে তাদের মনের মধ্যে বাকশালের চেতনা জাগ্রত ছিল। সেই বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতেই শেখ হাসিনা ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি করেন। শেখ হাসিনা এতটাই প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন যে তাঁর প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু পরিণতি হিসেবে যেটা বললাম, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা শিখিনি। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যত দেরিতেই হোক, নির্মম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে। শেখ হাসিনার বেলায়ও তা-ই ঘটেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তা তারা শিকার করতে চায় না। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য এখনো অনুশোচনা করেনি। তারা দায় শিকার করেনি, ক্ষমাও চায়নি। তারা একটি স্বৈরতান্ত্রিক মাফিয়া শক্তি। এটা সারা পৃথিবী জানে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টও বলছে, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে এক হাজার চার শর বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনেক মানুষকে পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত একজন কুখ্যাত খুনি, গণহত্যাকারী, তাঁর দল ও সরকারকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না, দেওয়া উচিতও না। সুতরাং এই আওয়ামী লীগকে আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না। তাদের ক্ষমার আওতায় আনা হবে—এ প্রশ্নই অবান্তর। প্রথম থেকেই আমাদের দাবি ছিল, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমি নিজেই বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছি। আর যাঁরা ব্যক্তি হিসেবে দায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, তাঁদের অনেকেই দেশের বাইরে আছেন। আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে তাঁদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে থাকুন আর বিদেশে থাকুন, যেখানেই থাকুন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
প্রশ্ন : নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিভিন্ন দল। অনেকে প্রার্থী তালিকাও ঘোষণা করেছে। বিএনপির তরফ থেকে সে রকম কিছু দেখছি না। আপনাদের প্রস্তুতিটা কী রকম?
উত্তর : আমরা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। আমরা নির্বাচনমুখী দল। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমেই শুধু সরকার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময় থাকে, শুধু কিছু হালনাগাদ করতে হয়। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ চলছে। আমাদের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। তবে এবারের প্রার্থী নির্বাচনে আমাদের কিছু বিষয় আছে। বিগত দিনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়; তাঁদের মেধা, প্রজ্ঞা, ঘাম, শ্রম—সবকিছু বিবেচনায় নিতে হবে। এবার আমরা তারুণ্যের অংশগ্রহণ রাখতে চাই।
প্রশ্ন : দেশের বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের দলে অন্তঃকলহ দেখা দিচ্ছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। নানা অপরাধে আপনারা সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনারা আরো কঠোর কোনো বার্তা দিতে চান কি না?
উত্তর : বাংলাদেশের জনগণের বদ্ধমূল ধারণা, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবে। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকরা মনে করে, তাদের প্রার্থী বেশি যোগ্য, অন্যরা কম। এ রকম প্রতিযোগিতা আছে। এত বড় সংগঠনের কিছু কিছু জায়গায় এটা হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। আমরা যেকোনো অনৈতিক কাজের বিরোধী। তাই চাঁদাবাজির অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে সোপর্দও করছি। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যেহেতু আমরা ক্ষমতায় নেই, তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারছি না। তবে আমরা নীতিগতভাবে আমাদের বার্তা মাঠ পর্যায়ে দিয়ে দিয়েছি। নীতিবিরোধী কোনো কাজ, চাঁদাবাজি—এগুলো আমরা সহ্য করব না।
প্রশ্ন : এই সরকার একটা ভগ্নদশার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। অর্থনীতি ধ্বংস, সম্পদ পাচার ও লুণ্ঠন হয়েছে। বর্তমানে অর্থনীতি খুবই বেহাল। কোনো বিনিয়োগ আসছে না। সরকারে এলে এসব সংকট মোকাবেলায় আপনাদের প্রস্তুতি কী রকম?
উত্তর : আমরা বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। অর্থনীতি অনেকটা বিধ্বস্ত ও ঋণগ্রস্ত। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ একটাই। তা হলো সরকার অনির্বাচিত। কোনো অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কেউ ব্যাবসায়িক চুক্তিতে যেতে চায় না। এটা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত নীতি। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচিত সরকার আসবে, তত তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ