ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

চব্বিশের পটপরিবর্তনে ভারত-বিএনপি সম্পর্কের নতুন সমীকরণ

নিউজ ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৫
চব্বিশের পটপরিবর্তনে ভারত-বিএনপি সম্পর্কের নতুন সমীকরণ

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রতিবেশী ভারত বরাবরই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যেখানে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল শীতল ও সংশয়পূর্ণ।

 

দিল্লির পক্ষ থেকে অতীতে বিএনপি সরকারের সঙ্গে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হলেও, বিএনপি বরাবরই বলে এসেছে তারা সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক চায়, তবে ভারত-বিরোধী নয়।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়, যদিও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বরং, মোদী ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রসায়ন ও ভারতের ধারাবাহিক সমর্থনে দুই দেশের সরকার-পর্যায়ের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়।

তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ভারতের সঙ্গে বিএনপির নতুন সম্পর্ক গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণে বিএনপি আগ্রহ দেখালে, ভারতও সহযোগিতার হাত বাড়াতে প্রস্তুত থাকবে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপির শক্তিশালী ফলাফলের সম্ভাবনা থাকায়, ভারতের কাছে বিএনপি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে আগামী দিনে ভারত-বিএনপি সম্পর্কের নতুন রূপরেখা ও সমীকরণ গঠনের দিকে নজর রাখছে কূটনৈতিক মহল।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার (২০১৯-২০২০) রিভা গাঙ্গুলি দাস অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের এতকাল কোনও যোগাযোগ ছিল না একথা সঠিক নয়।  

তিনি বলেন, দেখুন এটা একটা ভুল ধারণা! এই ধারণাটা তৈরি হওয়ার কারণ আওয়ামী লীগ একটা খুব লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তো ওই পুরো সময়টা আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট লেভেলে তো আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ডিল করব, তাই না? কিন্তু তার মানে এই না যে অন্য কোনও পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে আমরা ডিল করতাম না বা কোনো এনগেজমেন্ট ছিল না! বরং ভালই ছিল।

তিনি আরো বলেন, আমি নিজে হাই কমিশনার হিসেবে অনেকবার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছি, বহুবার তাদের বলেওছি যে আপনারা ক্ল্যারিফাই করুন ভারতের প্রতি আপনাদের পলিসিটা ঠিক কী ... তো এরকম কনভার্সেশন আমাদের অনেক হয়েছে।

রিভা গাঙ্গুলি দাস আরও জানান, তখন সেখানকার তরুণ পার্লামেন্টারিয়ানদের যে ডেলিগেশন ভারতে আসত, তাতে বিরোধী দল ও বিএনপি-র এমপিরা সব সময় থাকতেন। কাজেই এটা বলা ভুল যে আমরা ওদের সঙ্গে কথাই বলতাম না বা কোনও এনগেজমেন্ট ছিল না!

তবে বিএনপির সঙ্গে ভারতের যে ঠিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, এ কথাটা দু'দেশে সকলেই জানেন ও মানেন।

প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র মোদী যখন ২০১৪তে দেশের ক্ষমতায় আসেন, তার পরেও বেশ কয়েক বছর দিল্লিতে ১১নম্বর অশোকা রোডের ঠিকানাতেই ছিল বিজেপির সদর দফতর ... তখন বাংলাদেশ থেকে বিএনপির নেতারা সেখানে একাধিকবার এসেছেন।

তখন দলে অত্যন্ত প্রভাবশালী রাম মাধব-সহ বিজেপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিএনপি-র প্রতিনিধিরা আলাপ-আলোচনাও করেছেন, এমন কী ঢাকায় দুর্গাপুজা দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু হয়নি, দুপক্ষের সম্পর্ক সেভাবে স্বাভাবিক হয়নি কখনওই!

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বর্তমান দূরত্ব ভারতের জন্য নতুন সুযোগ

বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বর্তমান মতবিরোধ এবং সম্পর্কের শৈত্যপ্রবাহ ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক পুনর্গঠনের নতুন সুযোগ তৈরি করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।  

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে মতপার্থক্য এখন স্পষ্ট। বিএনপির এক সিনিয়র নেতাও বলেছেন, ভবিষ্যতে কোনও জোটের সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার এসব পরিবর্তন সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং তা মূল্যায়ন করছে। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাধারণভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না, তবে বাংলাদেশ এই নিয়মের কিছুটা ব্যতিক্রম।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, যা নিয়ে তখন তুমুল বিতর্ক হয়েছিল।

বর্তমানে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখলেও ইসলামপন্থী দল, বিশেষ করে জামায়াতের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ্য। বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, জামায়াতের চিন্তাধারা ও তালেবানি প্রবণতার বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম, আছি এবং থাকব।

ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছেন, বিএনপির সঙ্গে ভবিষ্যৎ যেকোনো সম্পর্কের অন্যতম শর্ত হবে জামায়াতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা।

হিন্দু সুরক্ষা, ভারতবিরোধী রাজনীতি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বারবার তুলে ধরছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের সুরক্ষার বিষয়টি।  

বিজেপির শীর্ষ নেতা শমীক ভট্টাচার্য স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ওপার বাংলার ঘোষ, বসু, দত্ত, মিত্র, মতুয়া ও বৌদ্ধরা ভারতের আত্মীয় এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ভারতের অগ্রাধিকার।

তবে তিনি সতর্ক করে দেন, যদি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় গণহারে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়, তবে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ হবে। এই কারণেই ভারত চাইছে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত হোক।

দিল্লির কূটনৈতিক মহল মনে করে, বাংলাদেশের যেকোনো দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নির্ভর করবে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের অবস্থানের উপর। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পুরনো বিতর্ক আবার সামনে এসেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির অতীতে ভারত-বিরোধী অবস্থান, বিশেষ করে ২০০১–২০০৬ শাসনামলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় ও অস্ত্র পাচারের ঘটনাগুলো, এখনো দিল্লির দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞ শান্তনু মুখার্জি বলেন, তারেক রহমানের ভারত-বিরোধী বক্তব্য এবং খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রচার ভারত-বিরোধী হয়ে উঠলে বিএনপি হয়ত সাময়িকভাবে জনসমর্থন পেতে পারে, তবে ক্ষমতায় এলে বাস্তবতা বদলাবে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক রিভা গাঙ্গুলি দাস মনে করেন, বিএনপি যদি ভারতের প্রতি তাদের নীতিগত অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে, তবে উভয় দেশের মধ্যে বিশ্বাস গড়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।

সবশেষে, পর্যবেক্ষকদের মতে, যদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় বন্ধ হয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মতো সুবিধা বহাল থাকে, তাহলে ভারতের জন্য বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে কোনো বাধা থাকবে না।

নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ অবস্থানে ভারত

বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—নির্বাচনের আগে তারা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যভাবে অবস্থান নেবে না।  

বর্তমান কূটনৈতিক কৌশলে ভারত চায়, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং সে নির্বাচনে যেই দল জয়ী হোক না কেন, তার সঙ্গে একটি ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ বা কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে—এই প্রস্তুতি তারা আগেভাগেই নিতে চায়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার বলছে, তারা বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়, যেখানে সকল রাজনৈতিক দল ও মতভেদ থাকা সত্ত্বেও সবাই ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

সম্প্রতি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বাংলাদেশে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের উপর গুরুত্ব দেন।

বিজেপির রাজ্যসভা এমপি শমীক ভট্টাচার্যও এ প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল, এটা স্বাভাবিক। এখন তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ কাম্য নয় এবং ভারতও সেটি করছে না।

তিনি আরও যোগ করেন, নির্বাচনে যে দল জয়ী হবে, সরকার তাদের সঙ্গেই কাজ করবে— এটাই ভারতের অবস্থান।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৫

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।