প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে নিরাশ হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ হতাশ।
একজন সাংবাদিক হিসেবে ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। কথা বলেছি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সঙ্গে। এর সঙ্গে সরাসরি যারা জড়িত তারা এ নিয়ে কথা বলেছেন।
বৃহস্পতিবার যে ফলাফল বেরিয়েছে তাতে দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩। এ বছর দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। গত বছর শূন্য পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৫।
এবার সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর বা ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সে হিসেবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা বোর্ড, পিছিয়ে কুমিল্লা।
ফলাফলের তুলনামূলক চিত্রে দেখা গেছে, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। আর ফলাফলে পিছিয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এ বছর মোট পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২। আর কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৪৮ দশমিক ৮৬।
এ ছাড়া রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, যশোরে ৫০ দশমিক ২০, চট্টগ্রামে ৫২ দশমিক ৫৭, বরিশালে ৬২ দশমিক ৫৭, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬, দিনাজপুরে ৫৭ দশমিক ৪৯, ময়মনসিংহে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার গত পাঁচ বছরের ফলাফলে ব্যাপক উল্লম্ফন ছিল। করোনাভাইরাস ও জুলাই আন্দোলনের কারণে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কখনই সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস, কম বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হওয়ায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার ছড়াছড়ি ছিল।
তবে এবার সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর, পূর্ণ সময় ও পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় ফলাফল ব্যতিক্রমী হয় বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়া হয়। যাকে ‘অটোপাস’ বলা হয়ে থাকে। ফলাফল প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বিগত বছরের এসএসসির ফল বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ওই বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন। এরমধ্য জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন পরীক্ষার্থী, যা মোট পরীক্ষার্থীর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়া হয় ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এতে পাস করে ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন।
২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। এতে গড় পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ কম। ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন।
২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪। আগের বছরের চেয়ে পাসের হার কমে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পান ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। আগের বছরের চেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।
গণঅভ্যুত্থানের কারণে ২০২৪ সালে কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় সাবজেক্ট ম্যাপিং করে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হয়। এ বছর ৯টি সাধারণ ও মাদরাসা এবং কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
২০২৪ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেন ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পান ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসেবে ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বাড়ে ৫৩ হাজার ৫৪৬ জন।
পাঁচ বছর পর এবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। সব বিষয়ে পূর্ণমান, পূর্ণ সময় ও পূর্ণ সিলেবাসে এবার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ‘সহায়নুভূতির’ নম্বরও না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর প্রভাব পড়ে ফলাফলে।
এরআগে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২০০২ সাল পর্যন্ত ডিভিশন পদ্ধতি বা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ছিল। ২০০৩ সাল থেকে জিপিএ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা হয়, যেখানে পাঁচটি স্কেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। নতুন এ পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষার্থীদের বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।
জিপিএ পদ্ধতি চালুর প্রভাব পড়ে ২০০৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে। সে বছর পাসের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০০৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশে। এরপর থেকে পাসের হার ক্রমেই বাড়তে থাকে।
২০০৫ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছিলেন ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ২০০৬ সালে পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৬৫, ২০০৭ সালে ৬৫ দশমিক ৬০, ২০০৮ সালে ৭৬ দশমিক ১৯, ২০০৯ সালে ৭২ দশমিক ৭৮, ২০১০ সালে ৭৪ দশমিক ২৮, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ০৮, ২০১২ সালে ৭৮ দশমিক ৬৭, ২০১৩ সালে ৭৪ দশমিক ৩০, ২০১৫ সালে ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ।
২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সবশেষ ২০২৪ সালে পূর্ণ নম্বর, পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ সময়ে ফেরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। তবে কয়েকটি পরীক্ষা হওয়ার পর শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। এতে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। এ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সরকার পরিবর্তনের পর আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে পরীক্ষা আর না নেওয়ার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। তাতে বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করে। ওই বিষয়গুলোর পরীক্ষা না নিয়ে এসএসসির ফলাফল বিবেচনা করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এবার কেন ফলাফল এমন হলো তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাঁচ বছর পর এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে। এজন্য ফলাফল নিম্নমুখী বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে অতিরঞ্জিত ফল এড়াতে গ্রেস মার্কস বা সহানুভূতির মার্কস দেওয়া পরিহার করার নীতি অবলম্বনে শিক্ষার্থীদের ফল খারাপ হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
১১টি শিক্ষা বোর্ডর মোর্চা বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির পরীক্ষার এ ফলাফল নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এবার আমরা স্বাভাবিক পরীক্ষার ধারায় ফিরেছি। পূর্ণ সিলেবাস, পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এতে হয়তো শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমরা কিন্তু চাই না একজন পরীক্ষার্থীও ফেল করুক। তবে শিক্ষার মান যে তলানিতে নেমেছে; অতিরঞ্জিত যে ফলাফল বিগত বছরগুলোতে দেখানো হয়েছিল, তাতে ক্ষতি হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসতে তো হবে। এটা করতে গেলে কোথাও না কোথাও আপনাকে থামতেই হবে।
ঠিক একই ধরনের কথা বলেছেন তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকরা। তারা সরাসরি বলেছেন, গত কয়েক বছর কোনো লেখাপড়া ছিল না। স্বৈরাচারের সময়ে ডিম ভাজি আর নাচ-গান শেখাতে গিয়ে লেখাপড়া শিকেয় ওঠে। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল হয় উল্টো। ভালো করে না পড়েও অনেকে পাস করে যায়। কারণ পরীক্ষার পর খাতা দেখার সময়ে সব শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিতে বলা হয়। এটা ছিল সরকারের নীতি। এ নীতি অনুসরণ করে পরীক্ষক খাতা নিয়ে প্রধান পরীক্ষক বা হেড এক্সামিনারের কাছে গেলে বলা হতো, যান, ঠিক করে নিয়ে আসেন। অর্থাৎ পাস নম্বরের চেয়ে অনেক কম নম্বর পেলেও তাকে পাস করিয়ে দিতে বলা হতো।
নূর ইসলাম নামে যশোরের এক কলেক শিক্ষক বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশে কোনো পড়ালেখা ছিল না। পরিকল্পিতভাবে জাতিকে ধ্বংস করতে যা যা করা দরকার, তা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা করেছেন। তিনি অশিক্ষিত সার্টিফিকেটধারী নাগরিক সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠেন।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও প্রায় একই কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে দেওয়া হয়নি ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারণে। আমাদের সবকিছুকে স্বৈরশাসক ভারত-নির্ভর করে তোলে। কারণ মেধার বিকাশ ঘটলে দেশের উপকার হবে, এটা শেখ হাসিনার সরকার চায়নি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় ও কথিত ডোনেশন নামের ঘুষকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। একই কারণে অখ্যাত অনেক স্কুল- কলেজকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ফলে লেখাপড়ার বারোটা বেজেছে।
তারা বলেন, মফস্বলের অনেক স্কুল-কলেজে সামান্য আয়া পদে চাকরির জন্যে ২০ লাখ টাকা পযন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। অশিক্ষিত আওয়ামী লীগাররা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার সভাপতি হওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। ফলে ওইসব স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার পরিবেশ নির্বাসনে গেছে। এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হওয়ার শিক্ষার এ করুণ হাল ধরা পড়ে। অথচ আমাদের শিক্ষার্থীরা মেধাবী না, এ কথা বলার সুযোগ নেই। দেশের ভেতর ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। বিদেশে তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। এমনকি ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীরা যেসব স্লোগান দিয়েছে, বিক্ষোভ কর্মসূচির নামকরণ করেছে, দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে তা অসাধারণ স্মার্ট। তাই ফলাফল বিপর্যয়ের দোষ শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া মোটেও সমীচীন নয়।
সাইফুর রহমান সাইফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোর।
এমজেএফ