ঢাকা, বুধবার, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

বিশেষ লেখা

পথ দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

অদিতি করিম। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৫৮, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
পথ দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

একটা সংকটকাল, দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্ত; ঠিক সেই সময় যেন সাহসী কাণ্ডারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন। পুরো জাতি অনিশ্চয়তায় উৎকণ্ঠায়, আর সেখানে ধীর স্থির শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে পথ দেখাচ্ছেন একজন।

তিনি জাতির অভিভাবক, আলোর দিশারি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি যেন জাতিকে নিয়ে যাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। এই সংকট থেকে উত্তরণে অকুতোভয় এক সেনাপতির মতো জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ এক বছরের বেশি সময় পার করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ নানা রকম সংকট মোকাবেলা করেছে প্রতিনিয়ত।

এই সংকট ষড়যন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনতার যে ঐক্য হয়েছিল, সেই ঐক্য বিনষ্ট করা এবং জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া। সে জন্য শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা, গুজব, মিথ্যা অপপ্রচার। একদিকে নানা রকম মব সন্ত্রাস, অস্থিরতা; অন্যদিকে হতোদ্যম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যেন এক অগ্নিপরীক্ষায়।

কিন্তু এই সময়েও মানুষ আশাবাদী; আস্থা রাখছে একজন যোগ্য অভিভাবকের ওপর। তিনি হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের হাল ধরেছেন। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়ে তিনি বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন দৃঢ়ভাবে।

বৈরী আবহাওয়ায় আগলে রাখছেন বাংলাদেশকে।
জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি ছিল জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা। একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য গত ১৫ বছর লড়াই করেছে এ দেশের মানুষ। সেই লক্ষ্যেই আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। এই ঘোষণার পরই শুরু হয়েছে নতুন অস্থিরতা ও ষড়যন্ত্র। নানামুখী চক্রান্ত চলছে নির্বাচন বানচালের জন্য। কিন্তু এই সময়ে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেমন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য অভিভাবকসুলভ ভূমিকা রাখছেন; ঠিক অন্যদিকে নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি কোনো রকম আপস করছেন না। নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় অবস্থান তাঁর দৃঢ়তার প্রমাণ। এটাই শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈশিষ্ট্য। তিনি যেমন হাসিমুখে সবার বক্তব্য শোনেন, যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা সাদরে গ্রহণ করেন, ভিন্নমত তিনি সহ্য করতে পারেন; অন্যদিকে নিজের লক্ষ্য ও আদর্শেও অটল থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু অনভিপ্রেত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। স্পষ্টতই এই ঘটনাগুলো ঘটেছে নির্বাচন সামনে রেখে। নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য। এই সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়েও নানা রকম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে নানা রকম গুজব, গল্প ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সবকিছু অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দিয়ে লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি গত শুক্রবার সংঘটিত অনভিপ্রেত ঘটনার পর একদিকে যেমন এ ধরনের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে তিনি রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। প্রথম দফায় তিনি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি আরো সাতটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এইসব বৈঠকের মূলত লক্ষ্য হলো তিনটি।

প্রথমত, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তারা যেন জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেই ঐক্যের ধারা থেকে বিচ্যুত না হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে তারা যেন একমত হয়।

দ্বিতীয়ত, তিনি মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারি এবং আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো যেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে অবদান রাখে, সে জন্য তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। দেশটা আমাদের সবার। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সরকারের একার কাজ না। এখানে সব রাজনৈতিক দলকে ভূমিকা রাখতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে।

তৃতীয়ত, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি জাতির অভিভাবক এবং নিজ অভিপ্রায়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেননি; বরং গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত করেছে। কাজেই জাতির অভিভাবক হিসেবে সবাই তাঁর বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন—এটাই প্রত্যাশিত। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের যে অবস্থান, সেখান থেকে ড. ইউনূসের আহ্বানে তারা তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে বলেই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

গত শুক্রবার (২৯ আগস্ট) সংঘটিত ঘটনার পর বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক, আমাদের সার্বভৌমত্বের রক্ষক সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে নানা রকম গুজব ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। কোনো কোনো মহল সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করে উত্তেজনা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এই সময় সেনাপ্রধানকে নিয়ে নানা রকম আপত্তিকর মন্তব্য করেছে কোনো কোনো মহল। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন জাতির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে সেনাপ্রধান সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সরকারের প্রতি তাঁদের পূর্ণ আস্থা আছে। সশস্ত্র বাহিনী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এর ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের পরাজয় হলো। এতে গুজব সন্ত্রাস বন্ধ হবে বলেও আমাদের বিশ্বাস।

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর বিরোধ সৃষ্টির জন্য যে ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তা নির্বাচন বানচালের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে সেনাবাহিনী ও সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসিত করার একটা নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার ফলে সেই উদ্যোগও ভেস্তে গেল। তাঁর সঙ্গে সেনাপ্রধানের গত সোমবারের (১ সেপ্টেম্বর) বৈঠক যেন সুস্পষ্ট একটি বার্তা। এর ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে, বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন নির্বাচনের মহাসড়কে নিয়ে এলেন, তেমনি তিনি সশস্ত্র বাহিনীকেও আস্থায় নিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি জনগণকে আশ্বস্ত করলেন। বাংলাদেশে এখন যে নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, এ রকম আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে দেশবাসী মনে করে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৩ মাস দায়িত্বে থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট করেছেন। তা হলো তিনি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেন। জনগণের অভিপ্রায় তিনি অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর যেকোনো সিদ্ধান্ত তিনি জোর করে সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চান না, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যান। ড. ইউনূসের দায়িত্ব পালনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সবাইকে নিয়ে এগোতে চান। একা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সবাইকে সেটি করতে বাধ্য করেন না। নির্বাচনের ব্যাপারেও আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানা রকম মত আছে। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে প্রতিপক্ষের মতো আচরণ না করে, তাদের সমালোচনা না করে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর এ পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিনবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করলেন। এটিই একজন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা হওয়া উচিত। যেহেতু জামায়াত বা এনসিপি তাঁর ঘোষিত তারিখে নির্বাচনের ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করছে, সে জন্য তিনি জামায়াত ও এনসিপিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন না বা তাদের সমালোচনা করছেন না। বরং তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্য সৃষ্টির একটি যুক্তিবাদী সংস্কৃতি চালু করছেন, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারছে দেশের বাস্তবতা, বৈশ্বিক বাস্তবতা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে চায়। জনগণ একটি নির্বাচন চায়। এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো তাদের অবস্থান থেকে অনেক সময় বাস্তবতা বোঝে না। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি চারদিকের সবকিছু দেখছেন, বুঝছেন এবং অনুভব করছেন। সেই আলোকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কাজেই জনগণের ভাবনার সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনার দূরত্ব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেন। এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে পথ দেখান। সারা দেশে যখন গুজব, গুঞ্জন; সেই গুজব গুঞ্জনে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য তিনি বিবৃতি দেন না বা যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের সমালোচনা করেন না। বরং তিনি কাজ দিয়ে একটি স্বচ্ছতার মাধ্যমে এসব গুজবের অবসান ঘটান। এ কারণেই তিনি এখন পথপ্রদর্শক। সত্যিকারের অভিভাবক।

লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ই-মেইল : auditekarim@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।