ঢাকা, বুধবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৩ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

পিআর পদ্ধতি যেভাবে হিটলারকে ফ্যাসিস্ট বানিয়েছিল

সাগর আনোয়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৩, জুলাই ৮, ২০২৫
পিআর পদ্ধতি যেভাবে হিটলারকে ফ্যাসিস্ট বানিয়েছিল

পৃথিবীর ইতিহাসের এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার ও একনায়কের নাম এডলফ হিটলার। জার্মানির ইতিহাসে হিটলারের চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়া এবং একনায়কত্ব কায়েম ছিল একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক নাটকের পরিণতি।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে জার্মান রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য পতনের পর দেশটি গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর ও বিশৃঙ্খল। ১৯১৮ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কারণে বিশ বারের মতো সরকার গঠন ও ভাঙনের ঘটনা ঘটে। ফলে জনগণের বিশ্বাস হারায় গণতন্ত্র– আর সেই সুযোগে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার বিদ্যমান দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসেন হিটলার। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে এমনটাই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতি গবেষকরা।  

পিআর ভোটিং পদ্ধতি ও সরকারের পতন
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিতে চালু হয়েছিল ভাইমার গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রে নির্বাচন পদ্ধতি ছিল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (Proportional Representation- PR)। পিআর সিস্টেমের কারণে সে সময় জার্মানিতে অর্ধ শতাধিক আঞ্চলিক ছোট ছোট দল গড়ে ওঠে। পিআর ব্যবস্থার কারণে ছোট ছোট ওই দলগুলোও সংসদে প্রবেশ করতে পারত কিন্তু কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না। ফলে সরকার গঠন করতে বিভিন্ন মত ও পথের আঞ্চলিক ও প্রধান দলগুলোকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক জোট করতে হতো। কিন্তু স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য যেমন জোট প্রয়োজন ছিল সেটি গড়ে উঠতো না। ফলে সামান্য মত-পার্থক্য হলে সরকার থেকে ছোট দলগুলো সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতো আর সরকারের পতন ঘটতো।

সরকার গঠন ও পতনের সংখ্যা
১৯১৯ সালে জার্মানিতে প্রথম আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়। আর এই ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে জার্মানিতে মোট ২০টি সরকার গঠিত হয়। এর মধ্যে কিছু সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক মাস। অনেক সরকার ১ বছরের মধ্যেই ভেঙে যায়। ১৯২০ সালের পর এসপিডি, সেনট্রুম ও ডিডিপি দল মিলে বার বার জোট সরকার গঠন করলেও তা কখনোই স্থায়ী হয়নি। এই তিন দলের ও তাদের সাথে আঞ্চলিক দলগুলোর জোট বারবার গঠিত হয়েছে ও ভেঙেছে। অন্যদিকে অতি ডানপন্থী দল ডিএনভিপি ও বামপন্থী দল এসপিডি এবং কেপিডি কখনো সমঝোতার টেবিলে আলোচনায়ই বসেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মতপার্থক্য ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে জোটগুলো দ্রুত ভেঙে পড়তো।

পিআর পদ্ধতির দুর্বলতা
ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালের গবেষক ইমরান আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, এই আনুপাতিক ভোটিংয়ের ফলে জার্মানির একক দল সরকার গঠন করতে পারত না। সরকার গঠন করতে ও নানান সিদ্ধান্ত নিতে দলগুলোকে আপস করতে হতো। ফলে জোট সরকার দুর্বল হতো। এতে করে জনগণের মধ্যে সরকারের ওপর আস্থা কমে যেত। আর সরকার বার বার ভেঙে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটও প্রবল হয়ে উঠতো। এই ভঙ্গুর অর্থনীতি ও রাজনীতির শূন্যতার মাঝেই হিটলার শক্তিশালী নেতৃত্বের  প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যা তাকে অপ্রতিরোধ্য করে দেয়। এখান থেকে বাংলাদেশের মানুষেরও শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। এখন যারা সমঝোতা বা আলোচনার টেবিলে বসছেন না ভবিষ্যতে তাদের পরিণতি কি হবে সেটা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।  

হিটলারের জোট গঠনের কৌশল
ভঙ্গুর সরকার ও জোট রাজনীতির অনৈক্যের সুযোগে রাজনীতিতে নিজের দলের ওপর বিশ্বাস রাখার দাবি নিয়ে  জনপ্রিয় দলে পরিণত হয় হিটলারের নাৎসি পার্টি। ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নাৎসি পার্টি সবচেয়ে বড় বেশি ভোট পেলেও সরকার গঠন করার মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে চ্যান্সেলরের শপথ নিতে আমন্ত্রণ জানাননি। কিন্তু হিটলার সরকার গঠনের জন্য ছোট দলগুলোর সাথে সমঝোতা শুরু করে। দীর্ঘ আলোচনা মাধ্যমে বিভিন্ন দলকে বেশি সংখ্যক মন্ত্রিত্ব দিয়ে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন হিটলার। হিটলার ডানপন্থী রাজনীতিবিদ ফ্রাঞ্জ ফন পাপেন ও ডিএনভিপি নেতা আলফ্রেড উগেনবার্গকেও তার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হিটলার চ্যান্সেলর পদ ও মাত্র দু'টি মন্ত্রিত্ব নেবেন আর বাকি সব মন্ত্রিত্ব জোট দলগুলোকে দিয়ে দেবেন। দু'জন বাদে সব মন্ত্রিত্ব পেয়ে জোটের এই দুই নেতার ধারণা ছিল, হিটলারকে চ্যান্সেলর বানানো হলেও যেহেতু সব মন্ত্রী তাদের তাই পেছন থেকে তারাই হিটলারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে তারা প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে জোট নেতা হিটলারকে শপথ পড়াতে রাজি করান। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জোট সরকারের প্রধান হিসেবে প্রথমবারে মতো এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পান।  

জার্মানির সংসদে (রাইখস্ট্যাগে) আগুন ও ফ্যাসিস্ট হিটলারের যাত্রা
জোট সরকার গঠনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হিটলার রাষ্ট্রের সবকিছুতে নিজের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। এসময় জোট নেতারা হিটলারের বিরোধিতা শুরু করেন। এর মধ্যে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩– জার্মান পার্লামেন্টে আগুন লাগে। যে আগুন লাগার কারণ এখনও অস্পষ্ট। আগুন লাগার সাথে সাথে কোনো তদন্ত ছাড়াই হিটলার ঘোষণা করেন, কমিউনিস্টরা সংসদে আগুন দিয়েছে। সারা দেশে তিনি এই সংবাদ ছড়িয়ে দেন। আর রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে হিটলার সংসদে আগুন লেগেছে মর্মে জরুরি আইন জারি করে নাগরিক অধিকার স্থগিত করেন। এরপরই সারা দেশে হিটলার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার শুরু করেন। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন ডিক্রি জারি করে সংসদ ছাড়াই নিজে নিজেই আইন পাসের ক্ষমতা এককভাবে নিয়ে নেন। এভাবেই একনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় হিটলারের।  

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
১৯৩৩ সালের মাঝামাঝিতে হিটলার কমিউনিস্ট পার্টি কেপিডি ও সোশালিস্ট পার্টি এসপিডি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমন ঘোষণা দেখে হিটলারের সাবেক জোট সঙ্গীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের দলকেই বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এমনকি শক্তিশালী দল সেন্ট্রুমও নিজেদের বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরপর  ১৪ জুলাই ১৯৩৩ সালে নাৎসি পার্টি ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন হিটলার। এভাবেই গণতান্ত্রিক পিআর পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে  একনায়ক হিটলার পুরো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।

ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইমরান আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, জার্মানির অভিজ্ঞতা দেখায়, যখন দেশে বারবার সরকার পরিবর্তন হয় কিংবা সরকার দুর্বল থাকে বা রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্য করতে ব্যর্থ হয়, তখন গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। বাইরের শক্তিও সুযোগ নেয়। এমন সময় স্বৈরতন্ত্রেরও উত্থান ঘটে। এজন্যই জার্মানিতে ৫% ভোটের কম পেলে কোনো দল সংসদে আসন পায় না। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে পিআর পদ্ধতি দেশটিকে শুধু ভয়াবহ সংকটেই শুধু ফেলবে না বরং বহিঃশত্রুদের দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগও করে দেবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহবুব বিন মালেক বাংলানিউজকে বলেন, পিআর পদ্ধতি পতিত স্বৈরাচারের ফিরে আসার পথ-মত, আদর্শ ও লোকবল জাতীয় রাজনীতিতে পুনবার্সিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী যদি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে পিআর সিস্টেম উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।  

তিনি বলেন, কিন্তু কিছু কিছু ছোটদল যেভাবে নিম্ন কক্ষেই অথবা বর্তমানে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে পিআর সিস্টেম চালুর দাবি করছে। তাতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রাজনীতি পুনর্বাসনের পথ দেশে তৈরি হবে।

এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।