ঢাকা, সোমবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২, ০৭ জুলাই ২০২৫, ১১ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

মবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের আশঙ্কা

মোস্তফা কামাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৮, জুলাই ৬, ২০২৫
মবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের আশঙ্কা

যদি-কিন্তু দিয়ে নানা তাত্ত্বিক বক্তব্যে মবের সাফাই গাওয়া ব্যক্তিরাও মানুষের গালমন্দ শুনতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের জন্য বদদোয়া করতেও ছাড়ছেন না।

সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে, মববাজরা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে মাটিচাপার দিকে টানছে। সরকারকে ফেলছে বেকায়দায়।

দেশকে নিয়ে যাচ্ছে আরেক সর্বনাশের দিকে। শুধু মানুষকে পিটিয়ে মারাই মব সন্ত্রাস নয়; ঘরবাড়ি দখল, প্রতিষ্ঠানে হামলা, পছন্দ না হলে যাকে-তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার ওপর হামলে পড়াও মব।
সরকার কারো ক্ষোভ-আবেগকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবে। কিন্তু ফয়সালা বা প্রতিকার করবে ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করে।

এটাই আইনের শাসন। গণ-অভ্যুত্থানের কয়েকজন ফ্রন্টলাইনার, ইউটিউব ব্যবসায়ী ও প্রধান উপদেষ্টার কাছের-কিনারের কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে মব পাণ্ডামির পক্ষ নিয়ে সাধারণ ও সচেতন মহলের সুবোধ উপলব্ধিকে উপেক্ষা করছে। এ ক্ষেত্রে ভরসার সারথি সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একাধিকবার এই মব উপদ্রব কঠোর হাতে দমনের কথা বলেছিলেন।

রংপুরে মব সন্ত্রাসীদের ডেকে ‘শরীরে রক্ত থাকতে এটা বরদাশত করা হবে না’ মর্মে এক সেনা কর্মকর্তার কঠোর বার্তার জ্যোতি একটু কমে গেছে মালুম করে এরা আবার কোথাও কোথাও নামছে। নমুনা বলছে, এরা দম নিয়েছে, দমেনি। আমাদের সেনাবাহিনী আফ্রিকার জঙ্গলে শান্তি আনতে পারলে নিজ দেশে পারবে না, তা ভাবা যায় না। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মহলবিশেষের মিথ্যাচার, উসকানি থাকলেও তা হালে পানি পায়নি, পাবেও না। মানুষকে খেপিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টাও এরই মধ্যে মাঠে মারা গেছে।

তাই সেনাপ্রধান বারবার মবের বিরুদ্ধে যে কঠোরতার বার্তা দিচ্ছেন, সেটার রিফ্লেকশন দেখতে চায় মানুষ।
বেশুমার রক্তদান-আত্মদানে জেগে ওঠা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা কারো জন্য সর্বনাশের চোরাবালিতে হারাতে দেওয়া যায় না। এ দেশে শাসকের ব্যর্থতা আছে বলেই জুলাই আসে, ডিসেম্বর আসে। তাই বলে মবও আসবে? এবারের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা হাতছাড়া হয়ে গেলে মব সন্ত্রাস নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হবে এবং তা নির্ঘাত দেশকে নেবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে। বিমারির মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার বাতিক বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এর ব্যাপকতা বাড়ছে। সব ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসছে না। কুমিল্লার মুরাদনগরে গ্রামবাসী নিজস্ব সিদ্ধান্তে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে এক পরিবারের তিন সদস্যকে। এ ঘটনায় ওই নারীর আরেক মেয়েকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে মাদক কেনাবেচার অভিযোগ। পুলিশ বলছে, এটিও একটি মব, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পুলিশ যথাযথ অ্যাকশনে যেতে পারেনি। বাঁচাতে পারেনি তিনটি প্রাণ। এটি মব এবং পুলিশের অসহায়ত্বের আরেকটি দৃষ্টান্ত। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে ৯৪ জনের। গত ১০ মাসে এই সংখ্যা দুই শর কাছাকাছি। চলমান মব সংস্কৃতির হামলা, গণপিটুনি ও হত্যাকাণ্ড নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বার্তা দিচ্ছে। সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আইন ও বিচারের দ্বারস্থ না হয়ে মানুষ নিজেই নৃশংসতার পথে বিচারের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলে বিচার বিভাগের আবশ্যকতা হারিয়ে যায়, যা আধুনিক বিশ্বের কোনো বর্বর-অসভ্য দেশেও নেই।

কয়েকটি ঘটনায় স্পষ্ট, দেশে মববাজির একটা মধ্যস্বত্বভোগী গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সরকার মব চায় না। নিজে একজন মজলুম হওয়ার পরও স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে প্রতিশোধের মানসিকতা নেই। কেউ যেন আইন হাতে তুলে না নেন, বিচারের আগে বিচার না করেন—এ আহবান তিনি ক্ষমতায় বসার পরপরই জানিয়েছেন। তাঁর প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, সরকার মব ভায়োলেন্স সমর্থন করে না। সেনাপ্রধান ও তাঁর বাহিনীও মববিরোধী অবস্থান থেকে পিছু হটেনি। দেশের প্রধান দল বিএনপির অবস্থানও পরিষ্কার। মব নামের তৎপরতাকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এটি এক হিংস্র উন্মাদনা, মানবতার শত্রু। মব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরিবেশ বিপন্ন করবে বলে সংশয়ের কথাও জানিয়েছেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁর সাম্প্রতিক এক স্ট্যাটাসে মব বিষয়ে সবিস্তারে বলেছেন। বলেছেন, মব ভায়োলেন্স বা সংঘবদ্ধ আক্রমণের সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, মব ভায়োলেন্স বন্ধ করতে হবে। সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ রাজনৈতিক দলগুলো। মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে বহুদিন ধরে।

মানে দাঁড়াচ্ছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, সরকার বা প্রতিষ্ঠিত দল—কারো কাছেই মব সমর্থন পাচ্ছে না। তার পরও মব চলছে। ঘুরছে মবের ছড়ি। প্রচলিত বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ফায়দা লুটছে মিডলম্যানরা। নিজেদের জিঘাংসা ও আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে গিয়ে তারা সরকারকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। গোটা দেশকে লিপ্ত করছে কলঙ্কতিলকে। বিগত সরকারের আমলে বিশিষ্ট অনেক ব্যক্তিকে এ রকম ‘শাস্তি’ দেওয়া হয়েছে যুক্তি দাঁড় করিয়ে চলমান মবকে স্বাভাবিক প্রমাণের অপচেষ্টায় দেখা যাচ্ছে মহলবিশেষকে। তারা ভুলে যাচ্ছে, এসবের খেসারত গুনতে হয়েছে বিগত ফ্যাসিবাদকে। জান নিয়ে পালাতে হয়েছে। কতকাল তাদের এ পাপ ভুগতে হবে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। মাস দশেক ধরে মব তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস-ভবনে হামলা, বিগত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে হেনস্তা করা, বাড়িঘর, এমনকি অফিস দখল করার মতো ঘটনাগুলোর হোতাদের পরিণতিও অনিবার্য। কিন্তু তার আগে দেশের সর্বনাশের যে শঙ্কা ঘুরছে, এর লাগাম টানা জরুরি। এ জন্য হুমকি-ধমকি-বিবৃতি যথেষ্ট নয়। সব ঘটনার ভিডিও বা ছবি থাকে না। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলা সব ঘটনার ভিডিও বা ছবি কি থাকে? থাকা সম্ভব?

আবার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে কতগুলো ঘটনায় জড়িতদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে? গ্রেপ্তারের পরে তাদের পরিণতি কী হয়েছে—এসব প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের মুখে কথা কিন্তু আটকে থাকছে না। কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে যতগুলো বড় মবের ঘটনা ঘটেছে, সরকার চাইলে সেগুলো প্রতিহত করা তত কঠিন ছিল না; বিশেষ করে সেনাবাহিনী যখন বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে রয়েছে। রংপুরসহ কয়েক জায়গায় সেনাবাহিনীর কয়েকটি পদক্ষেপে মব সন্ত্রাসে কিছুটা দম পড়ে। সম্প্রতি আবার চড়েছে। সরকারের শক্ত পদক্ষেপের সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই মব ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সরকারকেও জড়িয়ে ফেলছে, যা সরকারের শাসনতান্ত্রিক এগিয়ে চলাকে পিছু টেনে ধরছে। নষ্ট করছে প্রধান উপদেষ্টার বিশ্বইমেজ। দেশকে নিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন পরিচিতির দিকে। দেশ ব্যর্থ হলে দায় মববাজদের নিতে হবে না। তাদের তখন খুঁজেও পাওয়া যাবে না। দায় পুরোটা বর্তাবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। শুনতে তিতা লাগলেও এ কথাই ধ্রুব সত্য।
ঘটনার ঘনঘটায় মানুষ ক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাহলে দেশে আইনের শাসন কোথায়? এই আক্রমণ ও হামলা থেকে উদ্ধারের উপায় কী? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও জনগণের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। তাঁদের ম্যাজিট্রেসি ক্ষমতাও আছে। তার পরও সংঘবদ্ধ শক্তির আইন হাতে তুলে নেওয়ার ব্যারাম থামছে না কেন? পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে কি মব সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে? সরকার কি সত্যিই মব ঠেকাতে চায়, নাকি তারাও মবে ভয় পায়? নাকি মবকে উসকানি দেয়? এমন কত প্রশ্ন যে ঘুরছে! এবং এসব প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে নিষ্পত্তিহীন দশায়।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।