যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি, যার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জাতিসংঘ, ন্যাটো, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জি-সেভেন এর সদস্য হওয়ায় বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রযুক্তি, শিক্ষা, গবেষণা এবং সামরিক শক্তির দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে। ফলে, এর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত সারা বিশ্বেই প্রভাব ফেলে।
সম্প্রতি ২০২৫ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর নতুন শুল্কহার নির্ধারণ করেছেন, যেখানে সব দেশকে একই মানদণ্ডে বিবেচনা করা হয়েছে। ঘোষণায় উন্নত, উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এক ও অভিন্ন শুল্কহার নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। যদিও পরে শুল্ক আরোপের ঘোষণা চীন ছাড়া অন্যসব দেশের জন্য তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যে আলোচনাসাপেক্ষে এই শুল্কহার হ্রাসও হতে পারে, প্রত্যাহারও হতে পারে, আবার বজায়ও থাকতে পারে।
জানা যায়, মার্কিন আমদানির উপর শুল্ক হার নির্ধারণে অনুসৃত নীতি হলো একটি দেশ কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র হতে আমদানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি পরিমাণ এবং উক্ত আমদানির ওপর সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক আরোপিত শুল্ক হার বিবেচনায় নিয়ে উক্ত দেশের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত পণ্য / সেবার উপর শুল্ক হার নির্ধারণ করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সামর্থ্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মতো নয়। এই দেশগুলোর পণ্য আমদানি, উৎপাদন ব্যয় এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত।
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চমূল্যের পণ্য আমদানি করা দুরূহ। এখানকার ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ এখনো জাপানি ব্যবহৃত (সেকেন্ড হ্যান্ড) গাড়ির ওপর নির্ভরশীল, কারণ নতুন ও উচ্চমূল্যের মার্কিন গাড়ি বা যন্ত্রাংশ কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। একই চিত্র অন্যান্য অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র হতে পণ্য আমদানির মূল্যের ভারসাম্য রক্ষা করা অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি শূন্য করা বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক নির্ধারণ পদ্ধতি এসব অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়বে। অন্যদিকে অন্যান্য উন্নত দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্র হতে পণ্য আমদানিতে এগিয়ে থাকায় তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক তুলনামূলকভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক হতে কম। ফলে অনুন্নত দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উন্নত দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়বে। এতে তাদের তৈরি শিল্প- প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়তে পারে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ ও অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে মার্কিন প্রশাসনের উচিত হবে, এসব দেশের জন্য শুল্কহার পুনর্বিবেচনা করা।
বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী একটি শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা নয়, বরং অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে বৈশ্বিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করাও।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহকে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হতে হবে যে, সর্বোচ্চ ইচ্ছে ও প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতার নিরিখে ও সক্ষমতার অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি একেবারে সম্পূর্ণ শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না, তবে যতটুকু সম্ভব কামিয়ে আনা হবে। আরও বোঝাতে হবে এই শুল্কহার তাদের দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে এবং এই দেশসমূহে বাসবাসকারী জনগণের জীবন বিপন্ন করবে। মার্কিন সরকারকে যদি যুক্তি সহকারে বোঝানো যায় এসব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জীবন রক্ষার্থে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী, মানবিক, নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব আছে এবং মানুষের কথা ভেবে শুল্কহার যুক্তিসঙ্গত হারে পুনর্বিন্যাস করবে। আমরা আশা করি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের বাস্তবতা বিবেচনায় শুল্কহার পুনর্মূল্যায়ন করবেন এবং এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ও দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবেন।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
ইমেইল: mshahariar@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২৫