৫ আগস্ট ২০২৪, সকাল ১০টা। আমার সহকর্মী ফেরদৌস ভাই কল দিলেন।
ফেরদৌস ভাই পরে বললেন, অফিসের কার্ড নিয়ে এসেছেন? তাহলে বাইকটা নিয়ে একটু শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেখেন পরিস্থিতি কী। তবে সাবধানে থাকবেন। নিজেকে সামলে রাখবেন। আমি বের হয়ে পড়লাম। আগারগাঁও হয়ে বিজয় সরণি, তারপর ফার্মগেট হয়ে কারওয়ান বাজার হয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি। পথে সামরিক চৌকি দেখলাম। তারা বাধা দিল না। কারওয়ান বাজার এলাকা থমথমে শান্ত, বাংলামোটরে একটা সেনাবাহিনীর গাড়ি, পাশেই পোড়া একটা সেডান। আমি মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম পরীবাগের গলিতে মানুষের মাথা, গোনা যায় না। তারা অপেক্ষা করছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বড় বড় দুটি ট্যাংক। একজন সেনা সদস্য বললেন, সামনে যাওয়া যাবে না। গলায় কার্ড দেখে বললেন, কোথায় যাবেন? উত্তর দিলাম, শাহবাগ হয়ে শহীদ মিনার। তিনি বললেন, যেতে পারবেন না। পরীবাগ হয়ে ঘুরে যেতে পারেন কিনা দেখেন। বাইক ঘুরিয়ে সোজা টান দিলাম। বাংলামোটর আসার পর দেখি সাধারণ মানুষগুলো ভিড় করছে। আমি পরীবাগের দিকে গেলাম। একটা সেনা চৌকি ছিল। এক সেনাসদস্য আমাকে বলল, ফিরে যান। যাওয়া যাবে না। আমি মিরপুরের দিকে ফিরছি। বুকে আশা, চোখে অশ্রু। আজই হয়তো হবে। হলো। আমি নিশ্বাস নিলাম পরম তৃপ্তিতে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দিন। ইতিহাসের সোনার পাতায় হীরা, মণি, মুক্তা দিয়ে লেখা একটি দিন। বিজয়ের দিন। এই দিন বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। হাসিনা নামক এক রক্তপিশাচ এ দেশ থেকে পালিয়েছে। আওয়ামী লীগ নামে একটি খুনি-ফ্যাসিস্ট দলের পতন হয়েছে। টানা ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলন এদিন সফল হয়েছে; মুক্ত আকাশে স্বাধীনতা ডানা মেলেছে।
বাংলাদেশের নতুন স্বাধীনতার এ যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। কার্যত এটিই ছিল ২০২৪ সালের বৃহত্তর আন্দোলনের সূতিকাগার। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে মেধার অবমূল্যায়ন ও বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির প্রতিবাদ করে আসছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সেই অসন্তোষ পরিণত হয় বৃহত্তর ছাত্র অভ্যুত্থানে।
সরকারি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছিল। মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করার দাবি ছিল এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ফেরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কার ও সমাজে সকল ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা। এ আন্দোলন পরবর্তীতে অসহযোগ ও সর্বাত্মক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলন চলাকালে সরকারি মদদে শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন জনমনে ক্ষোভ ছড়ায়। পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনে নতুন গতি আনে এবং দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ তীব্রতর হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই বৈষম্যবিরোধী একটি বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। সারাদেশের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ এতে সংহতি প্রকাশ করে।
শিক্ষার্থীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়ক অবরোধ, ধর্মঘট, অবস্থান কর্মসূচি এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে থাকে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও আন্দোলনে সমর্থন জানায়। সরকার আন্দোলন দমনে হিংস্র দৈত্য হয়ে ওঠে। দিনের আলোয় হত্যা, অত্যাচার, নির্যাতন চালাতে থাকে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে শিশুদেরও হত্যা করে। শেষতক টানা ৩৬ দিনের ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটে। ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত এই গণআন্দোলন স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথকে প্রশস্ত করে।
এই পথের একজন পথিক ছিলাম আমিও। মনে প্রাণে শতভাগ বাংলাদেশি, এই সত্তাকে মনে ধারণ করেই বড় হয়েছি। পেশায় সাংবাদিক। ছাত্র থাকার অবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স আরোপের প্রতিবাদে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। একে সাংবাদিক, তারওপর ছাত্র হিসেবে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের হুমকি-ধমকি শুনেছি। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময়ও বসে থাকিনি। সরকারের তাবেদারি না করায় পুলিশের হয়রানির শিকার হয়েছি। সেই আমি কোটা সংস্কারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেব না, তা হতেই পারে না। ফলে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। পেশার কারণে ওতপ্রোতভাবে অংশ নিতে না পারলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে জুড়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর কোনোভাবেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না। রাস্তায় সম্মুখ সারিতে যাওয়ার উপায় ছিল না সংসার ও পরিজনদের কারণে। তাই যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হওয়া আন্দোলনে। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপের মাধ্যমে। আমার বিভাগের ছোট ভাইবোনগুলোকে পথ দেখাতাম, কীভাবে, কোন পথে এগিয়ে গেলে জনমানুষের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে আলোচনা হতো। কাদের কোন পয়েন্টে রাখতে হবে; মেয়েদের সুরক্ষায় কী কী করতে হবে। একইসঙ্গে নিজ এলাকায় জনমত সংগ্রহ করতাম। আমার এলাকায় থাকা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সকাল ও রাতে আলাপ করতাম। প্রতিদিন কী হচ্ছে খবরা-খবর রাখতাম। ওরাও আমাকে ফোন দিয়ে জানাতো, মিরপুরের কোন পয়েন্ট তারা দখল করেছে, আওয়ামী দোসর যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের ভূমিকা কী।
জুলাইয়ের শুরুর দিকে আন্দোলন সহিংস হয়ে না উঠলেও আমার আশঙ্কা ছিল। তাই ওদের সব সময় যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে বলতাম। কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়লে সবার আগে কাকে ফোন করতে হবে, কোন কোন জায়গায় অবস্থান করতে হবে, এমন দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল। একই সঙ্গে আমি আমার সাংবাদিকতা করতাম। ৮ ঘণ্টার ডিউটির পর মানুষ সাধারণত নিজের সংসার, বউ-বাচ্চাকে সময় দেয় বা ক্লান্ত শরীর নরম বিছানায় এলিয়ে দেয়। আমি পারতাম না। রাত হলে ফেরদৌস ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমতো। হঠাৎ করেই আন্দোলন প্রদীপের আলো নিভু নিভু হয়। আমার চিন্তা বাড়ে। ফেরদৌস ভাইকে বলি। তিনি অবিচল। বলেন, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে আওয়ামীগকে, শেষ করে দেবে।
প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় ফেরদৌস ভাইকে তার এলাকা থেকে তুলে নিয়ে দুজন একসঙ্গে যেতাম। আন্দোলনের দিনগুলোতেও তাকেসহ অফিসে গিয়েছি। মিরপুর-১০ নম্বরের পরিস্থিতি দেখতাম, ইসিবি চত্বরের পরিস্থিতি দেখেছি। ফেরদৌস ভাইয়ের কথার মিল পেলাম। ছাত্রদের শান্ত আন্দোলনে আওয়ামী লীগ আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৫ জুলাই শুরু হয় সহিংসতা। আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা অত্যাচার শুরু করলো, তখন আমি ভয় পেতাম। ভয় ছিল, এই যে ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নামছে, তাদের কারও জীবন চলে যায় কিনা! সেই আশঙ্কা সত্য হলো ১৬ জুলাই। পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ খুন হলো। মূলত সেদিন থেকে বিক্ষোভ রূপ নিতে শুরু করে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে।
সরকার যখন ছাত্রদের কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছিল, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শুরু করলো অত্যাচার, গুম, খুনের মতো নির্মমতা। কিন্তু তারপরও কোনো দিক থেকে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। দেওয়া হয় কারফিউ। এই দিনগুলোয় অফিসে যাতায়াত কঠিন হতো। কিন্তু আমরা যেতাম। যেতে যেতে দেখতাম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কত সাহস নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ইনফরমেশন নিতাম ফোনকলের মাধ্যমে। আলাপ হতো ফেরদৌস ভাইয়ের সঙ্গে। ত্রিশ মিনিট, ৪৫ মিনিট। কত কথা, কীভাবে কী হচ্ছে। আন্দোলনের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। নানা ঘটনায় জুলাই শেষ হতে থাকলো।
‘৩৪ জুলাই’ অর্থাৎ ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং ফ্যাসিবাদ নির্মূলের একদফা ঘোষণা দেন। এর পরপরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদিন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে একাধিক বৈঠকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শক্তি প্রদর্শন শুরু করে।
‘৩৫ জুলাই’ বা ৪ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা আন্দোলন প্রতিরোধে মাঠে নামে। তাদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি লাঠিসোঁটা, রামদাসহ নানা দেশীয় অস্ত্রও। মিরপুর-১০ নম্বরে আওয়ামী দোসরদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে তারা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। এদিন মিরপুর-১০ নম্বরে আমার সহকর্মী ফেরদৌস ভাইয়ের ছাত্র শাকিলকে মাথায় গুলি করে পুলিশ। ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাকে পিটিয়ে অর্ধমৃত করে রাস্তায় ফেলে রাখে। আমি আর ফেরদৌস ভাই তখন বাইকে, অফিসে যাচ্ছিলাম। মিরপুর দিয়ে যেতে না পেয়ে মাটিকাটা থেকে উত্তরার পথে ছিলাম। ফোন এলো। ফেরদৌস ভাই খবর পেলেন, শাকিল আহত, ওকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে ইসিবি ব্লক হয়ে আছে। ফেরদৌস ভাই নেমে হাঁটা শুরু করলেন। আমি অফিসে যেতে পারছিলাম না, তাই মিরপুর-১০ নম্বরে চলে এলাম। দেখা হলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই ও কলিগ ইফতির সঙ্গে। তিনি ১০ নম্বরে অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে ছিলেন। তার কাছে আমার বাইক রেখে মোবাইল হাতে দৌড়ে গেলাম ১০ নম্বর গোল চক্করের দিকে। দেখি পুলিশ বক্সে আগুন জ্বলছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাইনুল হোসেন খান নিখিল তার দলবল দিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু ছবি নেওয়ার পর ঘটনার ভিডিও করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। প্রাণের মায়া হারিয়ে ফেলেছিলাম। আশপাশে আহতদের দেখে অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমন সময় ইফতি ভাই ফোন দিলেন, বললেন ব্যাক করতে। আমি কথা শুনছিলাম না। বারবার তিনি কল করছিলেন। আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। গুলির শব্দে কান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, টিয়ার গ্যাসের কারণে চোখ জ্বলছিল। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় অনুভব করলাম ছাত্ররা পেছনের দিকে আসছে। একজন হাত টেনে ধরে বলল, আর সামনে যাইয়েন না। ওরা গুলি করছে। ইফতি ভাই আবার ফোন দিলেন। একটা গলিতে ঢুকলাম। সেখানে আগুন জ্বেলে বসেছিলাম কতক্ষণ। বাসায় ফিরলাম বিকেল ৩টায়।
মন ছটফট করছিল। ইন্টারনেট বন্ধ। আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নিচ্ছিলাম। জানতে পারলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নাহিদ ইসলাম ৫ আগস্টের নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সারা দেশে বিক্ষোভ ও গণ–অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। ৬ আগস্ট ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা’ স্লোগানে সারা দেশের ছাত্র, নাগরিক ও শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়ে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি হবে। আমি আমার এলাকার ছেলেদের সংগঠিত করার জন্য কল দিলাম। চাকরির মায়াও প্রায় ছেড়ে দিয়ে এবার রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলাম। বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। তার বাবার বাসায় অবস্থান করছিল। পুরো এক মাস নানাভাবে, নানা কায়দায় আমাকে সে বাসায় থাকতে বাধ্য করেছিল। ৪ তারিখ বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তাকেও কল দিলাম। বললাম, আমি যাচ্ছি। বাসায় ফিরতে পারলে তো ভালো। না পারলে আমার সন্তানকে বলবে, তার বাবা স্বার্থপর ছিল। তার কথা চিন্তা না করে আরও হাজারো মায়ের সন্তানের কথা ভেবে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমা চাইলাম আমার স্ত্রী মিমের কাছেও।
বিকেল ৫টায় খবর পেলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট ডেকেছেন। তার এই বার্তা আমার এলাকায় ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হলাম। এলাকার আওয়ামী দোসরগুলো হয়তো আমাকে মেরে ফেলতো। কারণ, আগের দিন প্রশাসনের লোক বলে কয়েকজন আমাকে খুঁজতে এসেছিল, এমন কথা শুনেছিলাম আমার বাসায় কেয়ারটেকারের কাছে। মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছতে শুনলাম আমার ছোট মামার বন্ধু কবির মামাকে গুলি করে মেরেছে নিখিলের লোকজন। তার বাসার দিকে যাওয়ার পথে শুনলাম এলাকার ছোট ভাই আহনাফ মিরপুর-১০ নম্বরে শহীদ হয়েছে। যে সংকল্প নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, সেটি হলো না। আমি ছুটলাম আহনাফদের বাসায়।
ফেরদৌস ভাইকে কল দিলাম রাতে। তিনি কেবল বাসায় ফিরেছেন। বললেন, খেতে এসেছি। রাতে আবার হাসপাতালে যেতে হবে। আমি প্রহর গুনছি। সারারাত ছটফট করছি। মিম বারবার কল করছে। ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত থাকতে বলছে। আমি পারছিলাম না। কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
৫ আগস্ট অর্থাৎ ৩৬ জুলাই সকাল ১০টায় ঘুম ভাঙে ফেরদৌস ভাইয়ের ফোনে। তিনি আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে, শাকিলের কাছে। ফ্রেশ হয়ে গেলাম তার কাছে।
সেখানে কথাবার্তার পর শাহবাগের দিকে গেলাম। শহীদ মিনার যেতে না পেয়ে মিরপুরের দিকে ফিরছি। বিজয় সরণি হয়ে মিরপুর-১০ নম্বরের দিকে যাবো। চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের দিকে আসার পর বাবার কল পেলাম। জানালেন, ‘সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ডাইনি হাসিনা নাকি পালিয়েছে। ’ সত্য নাকি মিথ্যা বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ আওয়াজ পেলাম শত শত মানুষের। তারা এগিয়ে আসছেন, শহীদ মিনারে যাবেন বলে। আমার যেন কী হলো, তাদের দেখে চিৎকার করে উঠলাম, ‘পালাইছে, পালাইছে’। কয়েকজন ছুটে এলো। আমাকে ঘিরে ধরলো। মনে হচ্ছিল, আমার সময় শেষ। তারা জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে, কে পালিয়েছে। সাহস নিয়ে বললাম, ‘হাসিনা ডাইনি পালাইছে’। হঠাৎ, নিজেকে শূন্যে অনুভব করলাম। আমি শুধু আকাশ দেখছি। মানুষের কোলাহল। ছাত্র-জনতা আকাঙ্ক্ষিত খুশিতে আমাকে শূন্যে তুলে আনন্দ করছিল। তারা আমাকে মাটিতে নামিয়ে কোলাকুলি করলো। আমি কাঁদছি, তারা কাঁদছে। একজন মুরব্বি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ততক্ষণে ফেরদৌস ভাই ও তার বন্ধুরা গণভবনের গেট খুলে ফেলেছিলেন, পরে তার কাছ থেকে শুনেছি।
সেখান থেকে মিরপুর-১০ নম্বরের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া পার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেও পারলাম না। বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরলাম। দ্রুত আম্মুর হাতে দুই লোকমা ভাত খেয়ে বাসা থেকে নেমে গেলাম। উদ্দেশ্য, গণভবন।
এ সময়ের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া হয়। হাসিনার পদত্যাগের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে জনগণ বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। আন্দোলনকারী জনতাও গণভবনের অভিমুখে যেতে থাকে। আমার এলাকার ছোট ভাইগুলো আমার মোটরসাইকেলের পিছু নিল। পরিচিতজনরাও দেখলাম জোরে হাঁটছেন, আশপাশের বাসার মা-খালা-চাচিরাও বের হয়েছেন। সবার মুখে হাসি।
বাইকে চড়ে কল্যাণপুর, শ্যামলী হয়ে গণভবনের দিকে এগিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনোভাবে কলেজ গেটের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের বেসমেন্টে সেটি রেখে দৌড়াতে শুরু করলাম। আনন্দ, খুশি আমাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল, এগুতে পারছিলাম না। সময় নিলাম, স্নায়ুচাপ সামলে ছুটতে শুরু করলাম। হাজারো মানুষ আমার পাশাপাশি ছুটছিল। একটা সময় গন্তব্যে পৌঁছলাম। দেখি হাজার হাজার মানুষ গণভবনে ঢুকছে। তাদের ভিড়ে আমিও ঢুকতে শুরু করলাম। ততক্ষণে গণভবনের দেয়াল ভেঙে ফেলেছে জনতা।
আমি গণভবনে ঢুকলাম। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ভোগবিলাসের ভবন মানুষ কীভাবে ভাঙছে তা দেখতে লাগলাম। দীর্ঘ ১৬ বছর হাসিনার প্রতি মানুষের রাগ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। দেখলাম মানুষের খুশি, হাসি, আনন্দ। যা হারিয়ে যেতে ধরেছিল ২০১৪ সাল থেকে। মানুষ হাসিনার যত ছবি পেয়েছে, পাড়িয়ে নষ্ট করেছে। আমি দেখেছি জনতার ক্রোধ। তারা শেখ হাসিনার শয়নকক্ষ ভেঙেছে, ভেঙেছে তার ব্যবহৃত নানা বস্তু। আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল গণভবনের নানা স্থানে। বাগানের ফল-ফসল, লেকের মাছ, ফ্রিজে থাকা নানা পণ্য সবই নিয়ে গিয়েছিল মানুষ। গণভবনের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল, হাসিনা যে কক্ষে বসে নানা সময় নানা অনুষ্ঠান করেছেন, যে কক্ষে বসে ছাত্রদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’, ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছিল সেটিও বিনষ্ট করা হয়েছিল।
আমি গণভবনের পরিস্থিতি ভিডিও রেকর্ড করছিলাম। কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সবার ভাষা ছিল একই রকম, ফ্যাসিস্টের বিদায়— ছাত্র-জনতার বিজয়। গণভবনের একেবারে শেষ দিকে খালি স্থানে আগুন দেখেছিলাম। কেউ কেউ বলছিলেন, হাসিনা পালানোর আগে তার পাপাচারের দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। লোকমুখের এই কথা বিশ্বাস করা যায় না, তবে হতে পারে না তাও নয়। কেননা, ওই সময় নীল, লাল হলুদ রঙা দিস্তার পর দিস্তা কাগজ কোনো সাধারণ মানুষ পোড়ায়নি, সেটিও সত্য।
আমি দেখেছি একটি দলকে যারা গণভবনের মাঠে শোকরানা নামাজ আদায় করছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করছেন। একজনকে দেখলাম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য বিলাপ করছেন। গুম হওয়া মানুষ, যারা ফেরেনি তাদের জন্য আহাজারি করছেন। আমি ফুটেজগুলো অফিসে পাঠালাম।
বিকেল ৩টার পর গণভবনে মানুষের তিল ধারণের জায়গা ছিল না। অনেকে সংসদ ভবন দখল করে, অনেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিবাদের আস্তানা গণভবন দেখতে গিয়েছিলেন তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করতে। তারা গণভবনের দেয়ালে থুতু দিয়েছেন, হাসিনার কক্ষে দুয়েকজন ঘৃণার সর্বোচ্চটি প্রকাশ করেছেন। এত বেশি ক্ষোভ, এত বেশি ঘৃণা একদিনে জমা হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে হাসিনার ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রদর্শন মানুষকে ধীরে ধীরে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। যার প্রকাশ পেয়েছিল ৫ আগস্ট।
আন্দোলন চলাকালীন জুলাইয়ে এক অনুষ্ঠানে ফ্যাসিবাদের জননী দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না’। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনি পালিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার আগে হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে নাকি তিনি একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি সে সুযোগ পাননি।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবে এই দেশের দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। যারা একসময় শাসনযন্ত্র ব্যবহার করে জনগণকে দমিয়ে রেখেছিল, তারা আজ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ছাত্রদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। একমাত্র ছাত্রসমাজই দেশের জন্য বুক চিতিয়ে গুলির মুখে দাঁড়াতে পারে। একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশে অন্যায়ের কোনো স্থান নেই। এ দেশে আর কেউ অন্যায় করে পার পাবে না। ন্যায়বিচার ও সততা ছাড়া কোনো জাতিই এগিয়ে যেতে পারে না। যারা এখনো অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত, তাদের শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের মধ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।