হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী সূত্র এমনটি-ই নিশ্চিত করেছে। এর আগে রোববার (১৫ এপ্রিল) রাতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আদালতের কাছে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেন।
আর এতেই উঠে আসে আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের নাম। শুধু রুহুল আমিনই নন, এর সঙ্গে আরো ১২/১৩ জনের নাম এসেছে; যারা প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া শাহদাত হোসেন শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর তিনি দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যান। বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোনে বিষয়টি রুহুল আমিনকে জানান। প্রত্যুত্তরে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও। ’
রোববার (১৪ এপ্রিল) ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪ ধারায় এ জবানবন্দি দেন গ্রেফতার দুইজন। তাদের জবানবন্দি গ্রহণ সেদিন রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত চলে।
পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) তাহেরুল হক চৌহান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, পিবিআই এ মামলার দায়িত্ব পাওয়ার চার দিনের মধ্যে (১০-১৪ এপ্রিল) আমরা ঘটনার মূল নায়ক, যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করেছি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনের মধ্যে থেকে আদালতের কাছে তাদের হাজির করেছেন। আদালত দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সিআরপিসির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
‘আসামি দু’জন আদালতের কাছে তাদের স্বীকারোক্তি উপস্থাপন করেছেন। তারা পুরো বিষয়টি খোলাসা করেছেন। একেবারে কিভাবে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, কারা ঘটিয়েছে, কোন আঙ্গিকে ঘটিয়েছে, বিষয়গুলো এসেছে। দ্রুত আপনারা জানবেন। ’
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তারা (নূর ও শামীম) হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অপরাধ স্বীকার করেছেন। এখানে কয়েকজন সংশ্লিষ্ট ছিল, পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছে। তারা জেলখানা (কারাগারে বন্দি হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা) থেকে হুকুম পেয়েছেন। এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।
হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তাহেরুল হক চৌহান বলেন, এখন পর্যন্ত ১৩ জনের কথা বলা হচ্ছে। আরও কিছু নাম বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে। আমরা সেসব নিরীক্ষা করবো।
তিনি বলেন, আমরা দুইজনকে গ্রেফতার করেছি। বাকি দুইজনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। শিগগির ভালো খবর পাবেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায় হত্যাকাণ্ডটি আলোচনায় আসার শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে উঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের নাম। সোনাগাজী সাবের মো. পাইলট হাইস্কুল মাঠে নুসরাতের নামাজে জানাজার মঞ্চে রুহুল আমিনকে দেখে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ।
এরপর নুসরাতের কবর ও নুসরাতের বাড়িতে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যেতেও দেখা গেছে রুহুল আমিনকে। হত্যায় অভিযুক্ত এমন একজনের প্রকাশ্যে দম্ভ করে ঘুরে বেড়ানোকে ভালোভাবে নেয়নি স্থানীয় মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সিরাজ উদ-দৌলার খুটির জোর এ রুহুল আমিন। অধ্যক্ষ সিরাজ জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর খোলস পাল্টে হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুবিধা পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে নিয়েছেন পরিচালনা কমিটিতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ধরা পড়লেও এর আগে এমন অনেক অভিযোগ ধামাচাপা দিয়েছেন তিনি। রুহুল আমিনের ভরসায় সিরাজের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রাফির পরিবারকে হুমকি দিয়ে সফল না হয়ে তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এর আগে রাফিকে শ্লীলতাহানির মামলায় সিরাজকে গ্রেফতারের পর এসব সহযোগী তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও মাদ্রাসায় দফায় দফায় সভা করে।
উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, সিরাজের সঙ্গে রুহুল আমিনের বেশ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
তবে এ বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ রুহুল আমিন। তিনি বলেন ‘২৭ মার্চ যখন মামলা হয় তখন আমি নিজে তাকে গ্রেফতার করতে পুলিশকে সহযোগিতা করি।
‘আর স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় এ মাদ্রাসাটির পরিচালনায় আমাকে সম্মানসূচক পদে রাখা হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সখ্যতা নেই। ’
তার দিকে অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে লেখাতে আমার উপকার হয়েছে। আগে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না। এখন আমি মিডিয়ার সামনে গুছিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে পারছি।
গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এর আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে তারা চাপ দেয়।
পরে দগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে মারা যান নুসরাত।
শ্লীলতাহানির মামলায় আগে থেকেই কারাবন্দি ছিলেন সিরাজ উদদৌলা। হত্যা মামলা হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১৩ জন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে সিরাজ উদদৌলার ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত নূর উদ্দিনকে গত ১১ এপ্রিল রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে এবং শাহাদাত হোসেন শামীমকে ১২ এপ্রিল সকালে মুক্তাগাছা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
নুসরাত হত্যা মামলার ২নম্বর আসামি নূর উদ্দিন ও শামীম ৩নম্বর আসামি।
বাকি আসামিদের মধ্যে সিরাজ উদদৌলাসহ ১০ জন রিমান্ডে রয়েছেন। এরা হলেন- সিরাজ উদদৌলা (৭ দিন), জাবেদ হোসেন (৭ দিন), নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, আবছার উদ্দিন, আরিফুল ইসলাম, উম্মে সুলতানা পপি ও যোবায়ের হোসেন (৫ দিন রিমান্ড)।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৯
এসএইচডি/এমএ