ঢাকা: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে হবে, আমাদের বুঝতে হবে যে গণমাধ্যমে কাকে বলবো? সাংবাদিকদের কাছে আমি মাঝেমাঝে প্রশ্ন করি, আপনারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি সাংবাদিক নাকি রাজনীতিবিদ?
বুধবার (৬ আগস্ট) সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির আইনি কাঠামোর পর্যালোচনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সেন্টার ফর গভারন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) এর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি ড. আলী রীয়াজ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।
এ ছাড়াও আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ সহকারী অধ্যাপক, সিজিএস নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী এবং গণফোরাম সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা, রেজওয়ানুল হক রাজা, প্রধান সম্পাদক, মাছরাঙা টেলিভিশন এবং চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, রিয়াজ আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন, অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল, আসিফ বিন আলী, পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মাহবুব মোর্শেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস), মাহমুদা হাবীবা, সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল ও যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী কৃষকদল, সোনিয়া জামান খান, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সলিসিটার, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সুপ্রিম কোর্ট, কাজী জেসিন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মনজুরুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন, জাহিদ নেওয়াজ খান, সিনিয়র সাংবাদিক, ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ড. আলী রীয়াজ বলেন, আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে হবে, আমাদের বুঝতে হবে যে গণমাধ্যমে কাকে বলবো? তিনি আর বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছে আমি মাঝেমাঝে প্রশ্ন করি, আপনারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি সাংবাদিক নাকি রাজনীতিবিদ? এক বছর আগে জুলাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। উপস্থিত তারা কে কি বলেছিলেন এটা তো জানেন! এটা সাংবাদিকতা? এটাকে আপনি আমি সাংবাদিকতা বলবো? রক্ষা করবো তাকে?
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা আজকে সংকটের মধ্যে আছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল, আমরা কি পেয়েছি? না, পাইনি। কিন্তু তিনি যে কাজটা করতে পারতেন সেটি তিনি করছেন না। ১২ মাস-আঠারো মাস সময় নেওয়ার দরকার ছিল না। মিডিয়া সংস্কারে যেসব সুপারিশমালা সামনে আসছে, এ সুপারিশমালা থাকলে আগামী ১০ বছর কেন আগামী ১০০ বছরেও এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং অভিযোগ নিরসন নিয়ে আজকের এ আলোচনা। বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকার ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রেস কাউন্সিলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে এছাড়াও আরও অনেক কমিটি তৈরি করা হয়েছে কিন্তু আদতে সেই কমিটিগুলো কার্যকর কিছু করতে পারেনি। গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা সরাসরিও অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছি তা হলো তেমন কিছুই হয়নি।
পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, গত এক বছর বর্ষা বিপ্লবের পর মিডিয়া কি এখন স্বাধীন? পুরোপুরি স্বাধীন না হলেও অনেকাংশে স্বাধীন এইটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখনো হ্যারেসমেন্ট, ট্যাগিং বা ফ্যাসিস্ট এগুলোর যাই বলেন- সমালোচনা আমাদের বাঙালিদের অস্তিমজ্জায়, আমরা সমালোচনা নিতে পারি না। মিডিয়াতেও এইটার প্রতিফলন হচ্ছে। আপনি যদি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা ও করেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়া বা নানান প্ল্যাটফর্মে সমালোচনার শিকার হবেন বা বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপ সেখানে আবির্ভাব হবে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, মিডিয়া হাউজগুলোর সাংবাদিকরা ঠিকমতো বেতন ভাতা পান না। তাহলে আমরা কীভাবে ভালো সাংবাদিকতা আশা করব বা যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমার কাছে এখন মনে হয় সোনার পাথর বাটি।
অধ্যাপক এস এম শামীম রেজা বলেন, সেলফ রেগুলেশন এর ব্যাপারটি অনেক জোরেসোরে সামনে আসছে, তার মানে কি আমরা ধরে নিচ্ছি সাংবাদিকরা অন্য আইনি সুরক্ষা পাবেন না? তার ওপর যে অবিচারগুলো হয়, যে চাপগুলো আসে সেগুলো নিরসন করা হবে না, শুধু সেলফ রেগুলেশনে যাব! ব্যাপারটি যেন এরকম না হয়।
রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, মিডিয়া কমিশন রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর, কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ ১৫ দফা বিশিষ্ট একটি সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে যেটি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর মধ্যে একটি ছিল প্রেস কাউন্সিল বিলুপ্ত করে প্রেস কমিশন গঠন করা। দুর্ভাগ্যবশত সেটি তোয়াক্কা না করে প্রেস কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
রিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অলমোস্ট নন এক্সিস্টিং একটা ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এটি যদি না হতো তবে আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এগুলোর আশ্রয়ে সাধারণ লোকদের গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ঘটতো না।
ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল বলেন, সংবাদপত্রের যেসব মিডিয়া হাউজগুলো প্রতিষ্ঠিত তারা একটা কর্পোরেট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন বা তারা সে জায়গা থেকে আছেন। সেখানে সংবাদপত্র ঠিক সংবাদপত্রের মতো আচরণ করে না। সে মিডিয়া হাউজ কিন্তু সে সংগঠন বা বড় গোষ্ঠীকে তার প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করে। ফলে তাদের আর্থিক ভিত্তি হয়তো শক্ত হয়, কিন্তু তার বিপরীতে যখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ব্যাপারটি আসে তখন সে আর্থিক ভিত্তিটা শক্ত থাকে না।
আসিফ বিন আলী বলেন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, তারা রাজনৈতিক অর্থনীতির জায়গা থেকে কাজ করছে। কে সরকারে বা কে সরকারের বাইরে এটি বিবেচনা করে না।
মাহবুব মোর্শেদ বলেন, এতবড় একটা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের আলোচ্য বিষয় থেকে ওয়েজ বোর্ড কীভাবে বাদ পড়ে গেলো? শুধু বাদ পড়ে যায়নি এটিকে বাইপাস করার জন্য অনৈতিকভাবে সরকারি চাকরির যে গ্রেড আছে, সে গ্রেডের নবম গ্রেড এখানে চাকরির শুরুতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন।
আমি মনে করি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এর একটি বড় স্ক্যাম হলো সাংবাদিকদের অধিকার, সুরক্ষা, চাকরির নিশ্চয়তা, বিশেষ করে আর্থিক নিরাপত্তার যে ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে। তারা একটি কর্পোরেট স্বার্থ এবং একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ বা ইন্টারেস্টকে সার্ভ করার জন্য এ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টটি তৈরি করেছে। সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা তো দূরের কথা তারা আর্থিক সুরক্ষার দিকেই নজর দেননি।
মাহমুদা হাবীবা বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক প্রণোদনা দরকার। তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা উচিত। তিনি বলেন, গণমাধ্যম কমিশনের আইন বাস্তবায়নের ক্ষমতা থাকতে হবে।
ড. সোনিয়া জামান বলেন, রাইট টু ইনফরমেশন গণমাধ্যমের স্বচ্ছতার জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন। কিন্তু এটি ফ্রিকুয়েন্টলি আন্ডার ইউটিলাইজড বা অবস্ট্রাক্টেড। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি ও নীতিগত সংস্কারের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
কাজী জেসিন বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তাদের উচিত ছিল একটি মিডিয়া তদন্ত কমিটি গঠন করা। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে রিপোর্ট চাইতে পারতো। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারত, যারা একদম পক্ষপাতদুষ্ট তাদের জন্যে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা নিতে পারতো। অতীতে যারা তথ্য গোপন করেছিল তারা সেটি এখনো করছে কিনা এটি জানা দরকার ছিল, কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন নানাভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে গণমাধ্যম তত বেশি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন আরেকটা নতুন চাপ কে আমার লোক কে আপনার লোক, কাকে বের করতে হবে, কাকে সংযুক্ত করতে হবে এ চাপ এটি গণমাধ্যমকে নষ্ট করছে।
ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, প্রেস কাউন্সিলের অবজেক্টিভ ও ফাংশন একবারে লিমিটেড নয়, একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন দেখি না বা খুবই অল্প সংখ্যক দেখা যায়। প্রেস কাউন্সিল যতটুকু সক্রিয় থাকার কথা সেটিও কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।
টিআর/আরআইএস