ঢাকা, বুধবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১১ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাই বিপ্লবের অকুতোভয় অংশীজনের নাম ইউট্যাব 

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:০২, আগস্ট ৬, ২০২৫
জুলাই বিপ্লবের অকুতোভয় অংশীজনের নাম ইউট্যাব  ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুগে যুগে জাতিকে পথ দেখিয়েছে।

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে, ক্রান্তিকালে দেশের হাল ধরেছে। এখান থেকে গড়ে ওঠা কোনো আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি। চব্বিশের গণ বিপ্লব তার আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙিণায় যে বীজ উপ্ত হয়েছিলো চব্বিশের জুলাইয়ে, আগস্টের ৫ তারিখ তা এক ফুলে-ফলে সুশোভিত বৃক্ষে রূপ নেয়। দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে সেই বৃক্ষের বক্ষ থেকে ছুটে আসা নির্মল বাতাসে যেন বুক ভরে নিশ্বাস নেয় এদেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা।  

সরকারি চাকুরিতে অযৌক্তিক কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে পহেলা জুলাই থেকেই রাজপথে গড়ে ওঠে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে তখন নিশ্চয়ই কেউ জানতো না এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফ্যাসিস্ট পতনের বীজ। এই আন্দোলনই হবে হাসিনা খেদাও আন্দোলন। এই কোটা সংস্কারই এক সময় রূপ নিবে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নামের এক অনবদ্য অভিযাত্রায়। শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলন শুরু থেকেই অত্যন্ত গোছালো ও পরিকল্পিত ছিলো। তাদের প্রত্যেকটি দিনের কর্মসূচীতে ছিলো ভিন্নতা। ছিলো দূরদর্শী নেতৃত্বের ছাপ। সে কারনে এই আন্দোলনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নজর ছিলো, ছিলো আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক আগ্রহও।  

বলা যায় বিপ্লবের সূচনাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে সক্রিয় ছিলো শিক্ষক সমাজ। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ওঠা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষকদের একটি বড় অংশই ছিলো সরাসরি জড়িত। তারা কখনো রাজপথে থেকে সন্তান তুল্য শিক্ষার্থীদের সাহস যুগয়েছেন। কখনো বুদ্ধি-পরামর্শসহ নানাভাবে হয়েছেন আন্দোলনের সারথি। এক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাবের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে সরব ও সুসংগঠিত।  

ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাব দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরেই জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিলো। বিএনপিসহ বিরোধী মত দমনে হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের কঠোর সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং রাজপথে নানা কর্মসূচী নিয়ে দেশব্যাপী শিক্ষকরা আন্দোলন গড়ে তোলে। যার সর্বশেষ পর্যায় ছিলো চব্বিশের জুলাই-আগস্ট।  

মধ্য জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যখন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা হামলে পড়ে তখন গর্জে ওঠেন ইউট্যাবের শিক্ষকরা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সংগঠিত হয়ে তারা দাঁড়িয়ে যান রাজপথে, শিক্ষার্থীদের পাশে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম হত্যার পর ১৬ জুলাই থেকেই দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। আন্দোলন দমাতে সরকারের নজর যায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।  

২০ জুলাইয়ের পর সরকার ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনৈতিক দমনপীড়ন শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে তাদের ধরে নিয়ে আসতে থাকে। ব্লক রেইড দিয়ে পুরো রাজধানীতে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হাসিনার পালিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অবস্থায় রাজপথেও দূর্বল হয়ে আসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।  

পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে সামনে নিয়ে আসে বিএনপি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাবকে আরো সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যদিও আন্দোলনের শুরু থেকেই ইউট্যাব সক্রিয় ছিলো। তবে দলীয় প্রধানের ওই নির্দেশের পর সরকারী-বেসরকারী ক্যাম্পাসগুলোতে সব ধরণের সহযোগিতা নিয়ে ইউট্যাব আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিল ও কর্মসূচী পালন করতে থাকে সংগঠনটি।  

পৃথিবীর আদিকাল হতেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। একটি আত্মিক সম্পর্ক। পৃথিবীর সকল যুগে, সকল দেশে এই সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি একই রকম। সক্রেটিস থেকে শুরু করে শেখ সাদী কিংবা আধুনিক কালের শিক্ষকরাও সম্পর্কের এই রসায়ন রপ্ত করেন। বলা যায় অনেকটা চুপিসারে, মনের অজান্তেই এই মধুর অথচ শক্তিশালী একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।  

চব্বিশের উত্তাল দিনগুলোয়ও সম্পর্কের সেই পূরণো রসায়ন চোখে পড়ে। কেননা শ্রেণি কক্ষে যে শিক্ষার্থীকে সততা, ন্যায় কিংবা দায়িত্বের প্রতি সজাগ-সচেতন করার সবক দেন শিক্ষকরা সেই শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে অরক্ষিত হয়ে পড়ে তখন তাদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষকদের কাছে। সমাজ সংস্কারের প্রধান গুরু শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত বিনির্মাণে পথ বাতলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদেরকে ন্যায্য অনায্য বুঝতে সাহায্য করা। তাদের জীবনে একটি পরিপূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া। সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। চব্বিশের আন্দোলন একটি ধ্রুব সত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো। সে কারনে শিক্ষক হয়ে এই আন্দোলন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিলো না। ইউট্যাব এই কঠিন সত্যকে উপলব্ধি করেই পাশে ছিলো সাধারণ ছাত্র-জনতার। সঙ্কটে তাদের একা করে যায়নি। সঙ্ঘাতে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বুলেটের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের এই সাহসী উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মনোবল বাড়িয়েছে। একটি দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।

আন্দোলনের একেকটি দিন যেন একটি বিভীষিকাময় অধ্যায় সামনে আসতে থাকে। ইউট্যাব তার সমস্ত শক্তি দিয়ে রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে থাকে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কিংবা শাহবাগ থেকে ভিসি চত্ত্বর সবখানে পুলিশের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে দেখা যায় শিক্ষকদের। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আগলে রেখে তাদের শক্তি-সাহস আর অনুপ্রেরণা হয়ে লক্ষ্যে স্থির থাকে ইউট্যাব।  

৫ আগস্ট। সারাদেশে কারফিউ বলবৎ রয়েছে। সকাল থেকেই থমথমে রাজধানী। হাজার হাজার নিরাপত্তা রক্ষী। আগ্রাসী  পুলিশের হাতে মারনাস্ত্র। সেনা বাহিনী-বিজিবির সাজোয়া যানে তাক করা রাইফেল। কালো পোশাকি র্যাবের ভয়ানক মহড়া। সবমিলে এক ভীতিকর পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের অস্তিত্ব তখনো নেই। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জড়ো হন ইউট্যাবের শিক্ষকরা। ইউট্যাব প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম এবং মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের নেতৃত্বে সেদিন শিক্ষকরা প্রথম কারফিউ ভাঙ্গে । এইসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের সকল নেতৃবৃন্দ। তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এগিয়ে গেলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সেদিন দাঁড়াতে পারেনি হাসিনার পুলিশ।  

ইউট্যাবের সেদিনের সেই কারফিউ ভাঙার দৃশ্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো রাজধানী জুড়ে কারফিউ ভাঙার হিড়িক পড়ে যায়। গুটিয়ে যায় হাসিনার নিরাপত্তা বেস্টনী। অলিগলিতে থাকা লাখ লাখ মানুষের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদের ক্যান্টনমেন্ট গণভবন। জন¯্রােত সেদিকেই ছুটতে থাকে। এরপর একটি কাঙিত বিজয়। দুুপুরের পরপরই হেলিকপ্টারে করে দিল্লি পালিয়ে যায় চব্বিশের গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাবের। যেই আন্দোলন ছিলো এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য। যেই আন্দোলন ছিলো একটি বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অংশ হতে পেরে ইউট্যাবের প্রতিটি সদস্য গর্বিত। এই গর্ব এদেশের প্রতিটি বোধবুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষকের। কেননা শিক্ষকরাই তো একটি সমাজ, একটি দেশ গড়ার সত্যিকারের সৈনিক।
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।