ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

নথি পোড়াতেই বিয়াম ভবনে আগুন, প্রাণ হারান দুজন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪৬, জুলাই ২৮, ২০২৫
নথি পোড়াতেই বিয়াম ভবনে আগুন, প্রাণ হারান দুজন

রাজধানীর হাতিরঝিলে বিয়াম ফাউন্ডেশন ভবনে বিস্ফোরণে দুজন নিহতের ঘটনা দুর্ঘটনা নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারা বলছে, নথিপত্র পোড়াতে পরিকল্পিতভাবে দেওয়া আগুনে এসি বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজন নিহত হন।

এই হত্যা মামলার মূল রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইঅ্যান্ডও, অরগানাইজড ক্রাইম-উত্তর)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম  (৩৬)।  

তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায়, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে গত ২৫ জুলাই কুড়িগ্রামের উলিপুরের পশ্চিম কানুডাঙ্গা গ্রামের নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিনই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড মো. জাহিদুল ইসলামকে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুইজনের বাড়িই কুড়িগ্রামে।

সোমবার (২৮ জুলাই) রাজধানীর কল্যাণপুরে পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন (এসআইঅ্যান্ডও) ইউনিটের (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান এই ইউনিটের পুলিশ সুপার মো. আবদুর রহমান। এ সময় এসআইঅ্যান্ডওর (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থোয়াইঅংপ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার মো. আবদুর রহমান জানান, গ্রেপ্তারের পরদিন জাহিদুল ও আশরাফুলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তবে মামলাটির তদন্ত এখনো অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আসামি শনাক্ত করে, তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।

ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টা ২০ মিনিটে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের বিয়াম ভবনে ৫০৪ নম্বর কক্ষে তীব্র শব্দসহ বিস্ফোরণ ঘটে।  

বিস্ফোরণে ৫০৪ নম্বর কক্ষে রক্ষিত সমিতির দলিলপত্র, নামজারি সংক্রান্ত কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাবের চেক বই, জমি ক্রয়সংক্রান্ত চারটি  চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র, কক্ষের এসিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

ঘটনার সময় অফিস সহায়ক মো. আব্দুল মালেক ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক মো. ফারুক গুরুতরভাবে আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।  

এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। থানা পুলিশের কাছে মামলাটি তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে গত ৬ মে পিবিআই এসআইঅ্যান্ডও (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার নেয় এবং এসআই মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

তিনি আরও জানান, মামলাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য একাধিক বিশেষায়িত টিম গঠন করা হয়। বিশেষায়িত টিম সিসিটিভি ফুটেজে বিশ্লেষণে জানতে পারে, রাত আড়াইটার দিকে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরা ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যায় এবং সিসিটিভি বন্ধ করে দেয়।  

পিবিআই এসআইঅ্যান্ডওর (উত্তর) বিশেষায়িত টিম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে সন্দেহভাজন আসামির ছবি শনাক্ত করে।

গ্রেপ্তার মো. আশরাফুল ইসলাম জানায়, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত বছরের ৫ আগস্টের দুই-তিন মাস আগে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা পাঁচ থেকে ছয় মাস রাখেন।  

জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে তিনি প্রায়ই বিয়াম প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতেন। এতে ওই অফিসের কয়েকজনের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আ. মালেক ও চালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করেন।  

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষে তাদের ১০-১২ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়। একদিন জাহিদ আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও  ফুল স্লিভ শার্ট জামা কেনেন। ঘটনার দিন আশরাফুল সেগুলো পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।  

ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও চালক ফারুক চতুর্থ তলার ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে চালক মালেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলায় নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ  হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক আ. মালেক মারা যান।  

ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এলে আশরাফুল কৌশলে হোটেল রুমে চলে যান। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় চালক ফারুককে জাতীয় বার্ন ইউনিট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান।  

চিকিৎসাধীন অবস্থায় চালক ফারুক মৃত্যুবরণ করলে জাহিদ আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিতে বলেন। জাহিদের কথা মতো পরদিন তিনি রংপুর চলে যান। এই কাজে আশরাফুলকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও জাহিদ এ পর্যন্ত তাকে ছয়-সাত লাখ টাকা দিয়েছেন।

এসসি/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।