ঢাকা, শনিবার, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ জুলাই ২০২৫, ০০ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

ইমেজ সংকটে সরকার

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৪৪, জুলাই ২৪, ২০২৫
ইমেজ সংকটে সরকার

দীর্ঘ এক বছরের কাছাকাছি সময় ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি হয়নি। বরং একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, সহিংসতা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় সরকার পড়েছে ইমেজ সংকটে।

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে বহু শিশুর প্রাণহানির ঘটনা সেই সংকটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৩৩ জন শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দেড় শতাধিক আহতের ঘটনা দেশজুড়ে গভীর শোক ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। জনবহুল স্থানে যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

জাতির এই শোকের মুহূর্তে সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তী পদক্ষেপগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, সমন্বয়হীন এবং বিভ্রান্তিকর। প্রশাসনিক ব্যর্থতার চিত্রটি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একের পর এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কতটা ভঙ্গুর। গাফিলতি, সিদ্ধান্তে বিলম্ব এবং সমন্বয়ের অভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সাধারণ মানুষ এমনকি রাজনীতিকদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে, সরকার আদৌ ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল কি না।

দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। সরকার হতাহতদের সংখ্যা জানালে, তা নিয়ে জনমনে তথ্য গোপন রাখার সন্দেহ সৃষ্টি করে। পরদিন অনুষ্ঠেয় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়সূচি নিয়েও সরকারের সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

রাত তিনটার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নয়, বরং অন্য দুই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের ফেসবুক পেজ থেকে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে, এতে পরীক্ষার্থীরা গভীর রাত পর্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় কাটায় এবং পরদিন অনেকেই কেন্দ্রের সামনে গিয়ে পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার খবর জানতে পারে। এতে শিক্ষা উপদেষ্টার ভূমিকা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাতেও ছিল বিশৃঙ্খলা। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে যখন আহতদের ভিড়, তখন সরকারি উপদেষ্টারা প্রটোকলসহ হাসপাতালে যান, যা চিকিৎসা কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। রাজনৈতিক নেতারাও দলে দলে সেখানে হাজির হলে পরিস্থিতি আরও অরাজক হয়ে ওঠে। চিকিৎসকরা বারবার জনতার ভিড় না করার অনুরোধ জানালেও সেদিকে দৃষ্টিপাত করেননি অনেকেই।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও প্রথম দিন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এ ঘটনায় খোদ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আশীর্বাদপুষ্ট দল হিসেবে পরিচিত এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমকে নিয়ে কড়া সমালোচনা করে বলেন, “আমাদের একজন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আছেন, তিনি মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই-বেরাদর কোটায় এসেছেন। ইউনূসের স্বজনপ্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। সব সময় বলে আসছি, এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কোনো প্রয়োজন নাই। ” স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে প্রধান উপদেষ্টার ‘কোটার নিযুক্তি’ বলেও আখ্যা দিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ মন্তব্য করেন, ইউনূসের পক্ষপাতের প্রতিফলন এই নিয়োগেই স্পষ্ট।

পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার পেজ থেকে দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের জন্য অর্থ সহায়তার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দিয়ে পরে তা সরিয়ে নেওয়া হয়, যা আরও বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, সমন্বয়ের অভাব এবং অদক্ষতা থেকেই জনমনে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা বেড়েছে।

দুর্ঘটনা পরবর্তী সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, “এমন একটি দুর্ঘটনায় জাতি স্তম্ভিত। সরকারের একের পর উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তও পরিলক্ষিত। এতে করে জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে সরকারের কাছ থেকে মানুষ স্বচ্ছতা আশা করে। সেই স্বচ্ছতা না এলে সরকারের ইমেজ সংকটে পড়বেই। ”

এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলানিউজকে বলেন, “যেকোনো দুর্ঘটনায় সরকারকে দুটি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়—দক্ষতা ও মানবিকতা। এই দুই ক্ষেত্রেই বর্তমান সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যা তাদের অভিজ্ঞতার অভাব এবং ইমেজ সংকটকে আরও প্রকট করেছে। ”

তিনি আরও বলেন, “যখনই দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়, তখন পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তিরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আমি আশাবাদী নির্বাচন ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিলের মধ্যেই হবে, তবে যদি কোনো কারণে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়, তাহলে রাষ্ট্র ভয়াবহ সংকটে পড়বে। ”

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, “কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট করেই মুখরোচক কোনো ঢালাও মন্তব্য করতে চাই না। তবে রাষ্ট্রের ভেতরে-বাইরে নানা ধরনের চক্রান্ত চলছে—এটা অস্বীকার করা যায় না। সেক্ষেত্রে সরকার কতটা দায়ী, এটা এখনই বলা মুশকিল। ”

এমন এক সময়ে যখন জাতি এক শোকাবহ পরিস্থিতিতে, তখন মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে লাঠিচার্জ ও হেনস্তার অভিযোগ ওঠে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও ক্ষোভের জন্ম দেয়। এদিকে সচিবালয়েও পরীক্ষার্থীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্তে বিলম্ব এবং সরকারের গাফিলতির প্রতিফলন ঘটে ওই বিক্ষোভে, যা পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়।

এরই মধ্যে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আববার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দুর্ঘটনায় কবলিত স্কুল পরিদর্শনে গেলে, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রায় নয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

এই অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দুই দিনে ১৭টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রথমদিন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে এবং পরদিন গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ আরও ১৩ দলের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেন। সরকার ঐক্য ও সহযোগিতার আহ্বান জানালেও কিছু দলের পক্ষ থেকে সরকারের সমন্বয়হীনতা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়।

বৈঠকে সরকার পরিচালনার দক্ষতা নিয়েও বিরূপ মন্তব্য ও কঠোর সমালোচনা করেন রাজনৈতিক নেতারা। একাধিক নেতা বলছেন, কেবল বেকায়দায় পড়লেই সরকার দলগুলোকে ডাকে। তারা মাসে অন্তত একবার সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজনের দাবি জানান, যাতে সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

এর আগে ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সমর্থকদের হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হলে এতে সরকারের ভূমিকা এবং মিটফোর্ডে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়া, দুইদিন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াসহ নানাকিছু মিলে জনমনে ভয়, ক্ষোভ ও অনাস্থা তৈরি হয়।

এদিকে সরকার যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা দিক থেকে চাপে রয়েছে, ঠিক তখনই একটি চিহ্নিত মহল রাজনৈতিক সুযোগ গ্রহণের দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতায় লিপ্ত আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। সচিবালয়ের ভেতরে গাড়ি ভাঙচুর, কর্মকর্তাদের হেনস্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মতো ঘটনার নেপথ্যে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ এবং ফ্যাসিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের আগে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত চলছে, যেখানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দোসররা নানা আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। যৌক্তিক আন্দোলনগুলোর ভেতর প্রবেশ করে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে এতসব জটিলতা ও প্রশ্নের মাঝেও জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানপন্থি দলগুলো সরকারের প্রতি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঐক্য বজায় রাখতে হলে সরকারকে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও মানবিকতা—এই তিনটি ক্ষেত্রে দ্রুত দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জনগণকে হিসাব দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের অদক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাবের এই চিত্র আরও গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এসবিডব্লিউ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।