একমাত্র উপার্জনক্ষম তরুণকে হারিয়ে দিশেহারা বরিশালের এক পরিবার। অর্থাভাবে এখন তারা অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে রয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, গ্রামের বাড়ি বানারীপাড়া হলেও রাকিব নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাবা মোশারেফ বেপারী, মা রাশিদা বেগম ও শারীরিক প্রতিবন্ধী বড় ভাই শাকিল বেপারীকে নিয়ে থাকতেন। তিনি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তবে আন্দোলনের সময়ে কাজে যাওয়ার কথা বলে ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন।
রাকিবের বড় ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী শাকিল বেপারী বলেন, আম্মু রাগ করবে ভেবে রাকিব কাজে যাওয়ার কথা বলত। ওর বন্ধুরা জানলেও আমরা জানতাম না। ঘটনার দিন ২১ জুলাই রাকিবের বন্ধুরা জানায়, ওর শরীরে গুলি লেগেছে। আমি তখন হতবাক হয়ে যাই। কারণ একটু আগেই ও আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গেছে। তার কিছু পরেই গুলির খবর আসে।
তিনি বলেন, খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রাকিবকে উদ্ধারে যাই। ততক্ষণে ওর বন্ধুরা রাকিবকে নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে রাকিব মারা যায়। তবে ওর বন্ধুরা তখনও আমাকে কিছু বলেনি। পরে হাসপাতালের স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পারি, রাকিব আর নেই।
শাকিল বলেন, হাসপাতাল থেকে রাকিবের লাশ ছাড়িয়ে আনতেও অনেক কষ্ট হয়। তারপর আমরা যেখানে ভাড়া থাকতাম, সেই ফতুল্লায় লাশ নিয়ে যাই। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে লাশ দেখাতে চাইলে বাধা দেন স্থানীয়রা। তাদের জন্য লাশ নামাতে পারিনি, এমনকি দাফন করতেও দেওয়া হয়নি। ও ছাত্র আন্দোলনে গিয়েছিল, এটাকেই ওর দোষ হিসেবে দেখা হয়েছে। বাধ্য হয়ে রাকিবের লাশ বানারীপাড়ায় দাদাবাড়িতে নিয়ে গিয়ে ২২ জুলাই দাফন করি।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে শহীদ রাকিবের শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাই শাকিল, বাবা মোশারেফ বেপারী ও মা রাশিদা বেগম বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার জম্বদীপ গ্রামে বসবাস করছেন। একমাত্র বোন সাথি থাকেন স্বামীর বাড়িতে।
জম্বদীপ গ্রামের বাড়ির ভিটে থাকলেও রাকিবদের নিজস্ব কোনো ঘর নেই। তারা এখন চাচা মো. নুরুল হক বেপারীর ঘরে আশ্রয়ে আছেন। নিজেদের ঘর তোলার আশায় ওই ভিটার পাশে একটি নিচু জমি বালু দিয়ে ভরাট করেছেন। তবে জুলাই ফাউন্ডেশনসহ যেসব জায়গা থেকে সাহায্য পেয়েছেন, তা পুরোপুরি ব্যয় হয়েছে ওই জমি ভরাটে। ফলে বর্তমানে আর্থিক সংকটে ঘর নির্মাণ আটকে আছে।
শাকিল বলেন, আমার বাবার বয়স হয়ে গেছে, কাজ করতে পারেন না। আমি নিজেও সব কাজ করতে পারি না, তবুও কোনো কাজ পেলে তা করতে যাই। মা শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। বাবার যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে কোনোভাবে ওষুধপানি চলছে। ঘর বানানোর জন্য জমি ভরাট করতে গিয়েই সব টাকা শেষ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় ভাইয়ের লাশ দাফন করতে না পেরে অনেক কষ্ট পেয়েছি। যেখানে বড় হয়েছি, সেই জায়গায় ঢুকতেও দেয়নি। এখন আমরা চাচার ঘরে থাকি, যা রান্না হয় তাই খাই। সরকার চাইলে আমাদের দিকে তাকাতে পারে। আমার ভাই শহীদ হয়েছে, আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী। এসব বিবেচনায় সরকার আমাদের একটু সাহায্য করুক। আমাদের একটা ঘর করে দিলে ভালো হয়। আর এমন কিছু একটা দিলে ভালো হয়, যেটা দিয়ে সারাজীবন উপার্জন করে বাঁচতে পারি।
রাকিব হত্যার ঘটনায় তার বাবা ফতুল্লা থানায় একটি মামলা করেছেন বলে জানান শাকিল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই।
রাকিবের চাচা মো. নুরুল হক বেপারী বলেন, রাকিব খুব ভালো ছেলে ছিল। একসময় ছাত্রদল করত। খুব ছোট বয়সেই সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর পরিবারটির অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সরকার সহায়তা দিলেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রাকিবের বাবা ও ভাই—দুজনেরই কাজ করার সামর্থ্য নেই।
তিনি বলেন, রাকিবদের ঘর নেই। তারা আমার ঘরে থাকে। আমি ভাইয়ের ছেলে ও ভাইঝিকে ফেলতে পারি না। সরকার যদি তাদের জন্য একটি ঘর করে দেয়, তাহলে থাকার মতো একটা ব্যবস্থা হবে।
রাকিবের চাচাতো বোনের স্বামী জয়নাল আবেদীন বলেন, রাকিব সবার খোঁজ রাখত। খুব ভালো ছেলে ছিল। যেদিন গুলি লাগে, সেদিনই আমরা জানতে পারি। প্রথমে শুনি পায়ে গুলি লেগেছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি মাথায় গুলি—এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। রাকিবের মৃত্যুর পর থেকেই আমার শ্বশুর (রাকিবের চাচা) পরিবারটির পাশে আছেন, কিন্তু এখন তাদের আরও বেশি সহায়তা দরকার।
তিনি বলেন, বিশেষ করে একটি ঘর দরকার এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী শাকিলের উপযোগী একটি চাকরির ব্যবস্থা দরকার। তা হলে রাকিবের বাবা-মা অন্তত তাদের বাকি জীবন একটু ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।
রাকিবের বাবা মোশারেফ হোসেন বলেন, আমাদের দরিদ্র পরিবারে রাকিবই ছিল একমাত্র ভরসা। আমি দিনমজুরি করি, যা আয় হয় তাতে সংসার চলে না। রাকিবের স্বপ্ন ছিল গ্রামের বাড়িতে আমাদের জন্য একটা ঘর বানানো। কিন্তু এখন সব তছনছ হয়ে গেছে।
আরএইচ