ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে ইসরায়েল যে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, তা তুলে ধরে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাগচি। তিনি বলেছেন, এখন থেকে ইরানি বিজ্ঞানীরা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে দেখিয়ে দেবেন, তারা কী করতে সক্ষম।
সম্প্রতি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ প্রকাশিত এক পোস্টে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে নেতানিয়াহুর বক্তব্যের জবাবে এ মন্তব্য করেন আরাগচি।
তিনি লেখেন, “নেতানিয়াহু প্রায় দুই বছর আগে গাজায় বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শেষ পরিণতি কী হলো? সামরিক জটিলতা, যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং নতুন করে হামাসে দুই লাখ তরুণের যোগদান। ইরানের ক্ষেত্রেও সে স্বপ্ন দেখেছিল যে, আমাদের ৪০ বছরেরও বেশি সময়ের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক অর্জনকে মুছে দেবে। ফল কী? তার ভাড়াটে ঘাতকেরা যেসব ইরানি বিজ্ঞানীকে শহীদ করেছে, তাদের প্রত্যেকে ১০০ জনেরও বেশি দক্ষ শিষ্য রেখে গেছেন। এখন তারা নেতানিয়াহুকে দেখাবেন, তারা কী করতে পারে। ”
আরাগচি আরও লেখেন, “কিন্তু নেতানিয়াহুর ঔদ্ধত্য এখানেই থেমে থাকে না। ইরানে যুদ্ধের কোনো লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে, আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তার গোপন সামরিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হওয়ার পর, যেগুলোর খবর সে এখনো সেন্সর করছে—সে দৌড়ে যায় ‘বাবা’র (ট্রাম্প) কাছে আশ্রয় নিতে। এখন সে নির্লজ্জভাবে আমেরিকাকে বলে দিচ্ছে, ইরানের সঙ্গে আলোচনায় কী বলা উচিত আর কী নয়। ”
ইরানের শীর্ষ এ কূটনীতিক কটাক্ষ করে বলেন, “একজন পলাতক যুদ্ধাপরাধীর কথায় ইরান কিছু মেনে নেবে—এটা হাস্যকর কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং প্রশ্ন থেকে যায়, নেতানিয়াহু আসলে কী সেবন করছেন? আর যদি কিছু না সেবন করেন, তাহলে মোসাদ আসলে হোয়াইট হাউসের বিরুদ্ধে কী তথ্য ফাঁস করে রেখেছে?”
ক্ষেপণাস্ত্র নিষেধাজ্ঞার অদ্ভুত দাবি
সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বক্তব্যে বলেন, “ইরানের সঙ্গে যেকোনো সম্ভাব্য চুক্তিতে আমাদের সমর্থনের শর্তগুলোর একটি হলো, ৪৮০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিষিদ্ধ করতে হবে। ”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মূলত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং তা পরমাণু চুক্তির অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রেক্ষাপট: ইরানের পাল্টা জবাব
ইরান বর্তমানে ২০০০ কিলোমিটার বা তার বেশি পাল্লার বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে তৈরি ও পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে: ‘খোররামশহর-৪’, ‘সিজিল’, ‘কিয়াম’, ‘দেজফুল’ ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধে এইসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরান ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা চালায় এবং বিভিন্ন শহরে বিস্তৃত ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়, যা নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা-বিষয়ক অবস্থানকে আরও চাপে ফেলে। এ কারণেই তিনি এখন ক্ষেপণাস্ত্র নিষেধাজ্ঞাকে চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
এ বিষয়ে ইরানের সংসদ স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইসরায়েল ক্ষয়ক্ষতির যে কথা স্বীকার করেছে, বাস্তবে তা সেটার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের শেষ দিকে আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ’
কালিবাফ দাবি করেন, ইসরায়েলে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা সম্ভবত ৫০০-এর কম নয়। কিন্তু দেশটির সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা মাত্র ২৯।
ইরানের অবস্থান স্পষ্ট
তবে ইরান বহুবার সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক এবং এটি কোনো আলোচনার বিষয় নয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একাধিকবার বলেছেন: “যারা চায় আমরা আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ত্যাগ করি, তারা আসলে চায় আমরা নিরস্ত্র হয়ে পড়ি—তা কখনোই হবে না। ”
গত ১৩ জুন জায়নবাদী ইসরায়েল ইরানের সামরিক, পারমাণবিক ও আবাসিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালায়, যা টানা ১২ দিন স্থায়ী ছিল। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রও এতে যোগ দেয় এবং ইরানের নাতাঞ্জ, ফোরদো ও ইস্পাহানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়।
এর জবাবে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর মহাকাশ ইউনিট ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ ৩’ নামে অভিযানে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ২২টি অভিযান চালায়, যার ফলে ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এটি পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি। ওই অভিযানে ইরান মোট ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে ৬টি নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, আল-উদেইদ ঘাঁটির অন্তত একটি গম্বুজাকৃতির কাঠামো (জিওডেসিক ডোম) সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই কাঠামোর ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত সংবেদনশীল সামরিক যোগাযোগের সরঞ্জাম ছিল, যা গোপন সামরিক অভিযানের জন্য ব্যবহার করা হতো।
২৪ জুন কার্যকর হওয়া এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। তবে উত্তেজনার পারদ এখনো তুঙ্গে।
লেখক: ইরান প্রবাসী সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
এমজেএফ