ঢাকা, শুক্রবার, ৬ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ জুন ২০২৫, ২৩ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে কীভাবে বের হবে ইরান?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:৫৮, জুন ২০, ২০২৫
ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে কীভাবে বের হবে ইরান? ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের জন্য আয়োজিত জানাজায় শোকার্ত ইরানি জনতা

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ থামাতে ইরানের হাতে বিকল্প খুবই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কৌশল নিলে উল্টো আরও ভয়াবহ পাল্টা হামলার মুখে পড়তে পারে দেশটি।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সামনে যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো স্পষ্ট পথ খোলা নেই। বরং এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়িয়ে ফেলতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি জটিল যুদ্ধের জন্ম দেবে।

১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে ইসরায়েল অন্তত ২৪০ জন ইরানিকে হত্যা করেছে, যাদের অনেকেই বেসামরিক নাগরিক। নিহতদের মধ্যে ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন।

ইসরায়েল ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্টেশনে হামলা চালিয়েছে, একটি হাসপাতালে আঘাত হেনেছে, আবাসিক ভবনগুলোকে লক্ষ্য করেছে এবং দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এর জবাবে ইরান ইসরায়েলের ওপর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, লক্ষ্য করেছে সামরিক ও নিরাপত্তা স্থাপনা, হাইফার তেল শোধনাগার, আবাসিক এলাকা এবং একটি হাসপাতাল। এই পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতেই নয়, বরং সম্ভব হলে দেশটির সরকার পতন ঘটাতেও চায়। ফলে এই পরিস্থিতিতে দ্রুত যুদ্ধ থামানো ইরানের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইরান বলছে, হামলার মুখে তারা কোনো আলোচনা করবে না, কারণ এতে আত্মসমর্পণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের কাউন্সিল ফর গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ইরান বিশেষজ্ঞ হামিদরেজা আজিজ মনে করেন, যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে থামাতে সক্ষম হন, তাহলে ইরান যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হতে পারে। কারণ তাদের প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধ ছড়ানো নয়, বন্ধ করা।

সীমিত বিকল্প
তত্ত্বগতভাবে ইরান আলোচনায় ফিরতে পারে এবং যুদ্ধ চলার মধ্যেও চুক্তি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে, এতে তাদের পুরো পরমাণু কর্মসূচি বাদ দিতে হবে, যা ভবিষ্যতে শত্রুদের কাছে ইরানকে আরও দুর্বল করে তুলবে।

বিশ্লেষক রেজা এইচ আকবারি বলেন, “পরমাণু কর্মসূচি ইরানের জন্য একটা কৌশলগত অস্ত্র। এটা ছাড়াও আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মাধ্যম। তাই এটা একেবারে ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ”

যুদ্ধ শুরুর আগে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পাঁচ দফা আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে অচলাবস্থা তৈরি হয় যখন ট্রাম্প ইরানের সম্পূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি বাদ দেওয়ার দাবি জানান, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে চালানোর অধিকার ইরানের রয়েছে।

ট্রাম্প এখন ইরানকে চুক্তিতে আসতে বলছেন, না হলে আরও ভয়ানক পরিণতির হুমকি দিচ্ছেন, এমনকি সরকারের পতনেরও ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

বিশ্লেষক নেগার মোর্তাজাভি বলেন, ইরান প্রতিটি হামলার জবাবে পাল্টা আঘাত না করলে ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। কিন্তু পাল্টা আঘাত দিলেও তাতে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বরং ইসরায়েলের কাছে আরও হামলার অজুহাত তৈরি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলা?
গত এক বছরে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবও অনেকটা ক্ষয় হয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ আগে ইরানকে ইসরায়েলের আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। কিন্তু গত বছরের যুদ্ধের পর তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে) ইরান আরও এক বড় মিত্র হারিয়েছে।

তবে ইরাকসহ নানা স্থানে ইরানপন্থী মিলিশিয়া গোষ্ঠী এখনো রয়েছে, যারা মার্কিন ঘাঁটিতে ‘হুঁশিয়ারি-ধর্মী’ হামলা চালাতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের জনমত প্রভাবিত হতে পারে।

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণকারী জনসমর্থকরা বিদেশে যুদ্ধের বিরোধী। আমেরিকান সৈন্য নিহত হলে যুদ্ধ বিরোধিতা আরও বাড়তে পারে।

তবে এই পথে হাঁটলে ইরান নিজেও বিপদে পড়বে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালিতে হামলার হুমকি দিলে বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে, তেলের দাম বাড়বে, যা ইরানের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করতে পারে।

বিশ্লেষক বারবারা স্লেভিন মনে করেন, ইরানের শ্রেষ্ঠ কৌশল হবে যুদ্ধকে সীমিত রাখা এবং সময় পার করা। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা বাড়লে তা ইরানের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

বিশ্লেষক এইচ আকবারিও একমত যে, ইরানের নেতারা জানেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়ালে পরিস্থিতি তাদের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কারণ এতে ইরানের গত ৪০ বছরের অর্জন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কৌশলগত হিসাব
ইরানের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বড় ক্ষতি সাধন করে যুদ্ধের মূল্যবোধ শেখানো।

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হাসান আহমাদিয়ান বলেন, “ইরান মনে করে তারা ইসরায়েলকে যথেষ্ট জবাব দিতে পারবে, যাতে ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য হয়। ”

তবে ইরান কতটা ক্ষতি করতে পেরেছে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ ইসরায়েল এসব তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশ করতে দেয় না।

এছাড়া ইরান কতদিন এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, তাও অনিশ্চিত।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালানো কঠিন হতে পারে। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কমে এসেছে, যা তাদের ইরানের দীর্ঘপাল্লার হামলার বিপক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যুদ্ধ দুই পক্ষেরই সীমাহীন ক্ষতির দিকে যাচ্ছে। তাই হয়তো ইরান এই বাজি খেলছে যে, একসময় ইসরায়েল নিজেই থেমে যেতে বাধ্য হবে।

বারবারা স্লেভিন বলেন, “এই মুহূর্তে ইরান নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কেউ বাঁচাবে না। নিজেদেরই পথ খুঁজে নিতে হবে। ”

সূত্র: আল জাজিরায় প্রকাশিত সাংবাদিক ও বিশ্লেষক ম্যাট নাশেদের প্রতিবেদনের ভাষান্তর।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।