মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্রমশ বাড়তে থাকা এক বাণিজ্য যুদ্ধে মুখোমুখি। ওই লড়াই ছোট-বড় বৈশ্বিক বাজার এবং ব্যবসাগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
ট্রাম্প ১৪৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে চীনকে ধাক্কা দেন। বেইজিং ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। মঙ্গলবার গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ আমদানিতে জাতীয় নিরাপত্তা পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্প তার বাণিজ্য কৌশল আরও জোরদার করেছেন। ওইসব খনিজের বেশিরভাগই চীন থেকে আসে।
এর আগে, ব্লুমবার্গ নিউজ জানায়, চীন তার বিমান সংস্থাগুলোকে বোয়িং জেট না কেনার এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিমানের সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ কেনা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে হংকংয়ের ডাক পরিষেবা ঘোষণা করেছে, তারা আর যুক্তরাষ্ট্রগামী ডাক পরিচালনা করবে না।
কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা ও কৌশল বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাদজিবুল্লা আল জাজিরাকে বলেন, ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে চীনের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। দুটি দেশের অর্থনীতির জন্যই ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি হবে। তার মতে, দুই দেশের পরস্পরকে পুরোপুরি ছেড়ে যাওয়া কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, কে প্রথমে পিছিয়ে যাবে, তা নির্ভর করে কে বেশি কষ্ট সহ্য করতে পারে এবং কে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত আছে তার ওপর।
বাণিজ্যে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, আমদানি শুল্ক দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কী অর্জন করতে চায়, তার কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য আছে কিনা।
প্রাক্তন মার্কিন সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের প্রধান আলোচকদের একজন হ্যারি ব্রডম্যান বলেন, ট্রাম্প চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে চান, নাকি দেশটির সাথে বাণিজ্য সরাসরি শেষ করতে চান, তা স্পষ্ট নয়।
যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা চালানোর জন্য চীনের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সঙ্গে ট্রাম্প কীভাবে বোঝাপড়া করছেন, আল জাজিরার কাছে ব্রডম্যান সেই প্রশ্ন রাখেন। তিনি বলেন, উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাজারে স্তর রয়েছে, উৎপাদকের কাছে সারা বিশ্ব থেকে উপাদান আসছে। বিশ্ব অর্থনীতি খাড়াভাবে সূক্ষ্মভাবে কাটা হয়েছে। তাই কারা বিজয়ী এবং কারা পরাজিত তা স্পষ্ট নয় বলে ব্রডম্যান মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সরল এবং অবাস্তব।
হ্যারি ব্রডম্যানের মতে, ট্রাম্প অবশ্যই রিয়েল এস্টেট বোঝেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার নয়... তিনি যা ভাবেন তা হলো, ‘আমি কীভাবে জিততে পারি এবং কীভাবে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারি?’ ব্রডম্যান বলেন, এটা এর চেয়ে বেশি পরিশীলিত কিছু নয়। তিনি অর্জিত সম্পদ ভাগাভাগি করতে আগ্রহী নন। কিন্তু এর মাধ্যমে আপনি খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না।
ট্রাম্প স্পষ্ট বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন আলোচনার টেবিলে আসা চীনের উপর নির্ভর করছে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট ট্রাম্পের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বল চীনের কোর্টে। লিভিট এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, চীনকে আমাদের সাথে একটি চুক্তি করতে হবে, আমাদের তাদের সাথে কোনো চুক্তি করতে হবে না।
মার্কিন অর্থনীতি চীনের তুলনায় তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে বাণিজ্য যুদ্ধে প্রবেশ করেছে। চীনা অর্থনীতি উচ্চ বেকারত্ব এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার মত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং অন্তত ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকেই বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের একজন অনাবাসী সিনিয়র ফেলো ডেক্সটার টিফ রবার্টস আল জাজিরাকে বলেন, চীন দ্রুত আলোচনার টেবিলে আসবে এবং হুমকির জবাব দেবে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই হিসাব ভুল। তিনি বলেন, চীনের জন্য এটি বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা দুই ক্ষেত্রেই প্রায় অস্তিত্বের লড়াই। যখন পশ্চিমাদের পতন ঘটছে, তখন পূর্বের উদয় ঘটছে, শি জিনপিংয়ের বারবার বলা বক্তব্যটি তিনি মনে করিয়ে দেন।
গত সপ্তাহে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলি জানায়, গত আট বছরের বাণিজ্য উত্তেজনার পর চীন আমদানি শুল্কের জন্য প্রস্তুত।
বছরের পর বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে গিয়ে চীন তার বাণিজ্যকে বৈচিত্র্যময় করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে সয়াবিনের মতো মার্কিন কৃষি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানো। পণ্যটির বেশিরভাগই এখন ব্রাজিল থেকে আসে।
২০২৪ সালে, চীনের রপ্তানির ১৪.৭ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল। ২০১৮ সালে পরিমাণটি ১৯.২ শতাংশ ছিল।
সোমবার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শি জিনপিংয়ের পাঁচ দিনের সফর শুরু হয়। সফরটির লক্ষ্য ছিল, ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আরও নির্ভরযোগ্য অংশীদার এবং মুক্ত বাণিজ্যের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে চীনের স্বঘোষিত ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করা।
চীনের জন্য রাজনৈতিক বিবেচনাও রয়েছে। শি জিংপিং একজন শক্তিশালী ব্যক্তির ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করলে সেই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি অভ্যন্তরীণভাবে এবং অন্যান্য দেশের সাথে চীনের লেনদেনের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি নিতে পারেন না, বলে রবার্টস জানান।
রবার্টস বলেন, সম্ভবত তারা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার এমন কিছু পদ্ধতি খুঁজে পাবে, যেখানে উভয় পক্ষই বিজয় উদযাপন করবে। তা না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আমি বুঝতেও পারছি না যে, এটি কীভাবে কাজ করবে। বৈশ্বিকভাবে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।
ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরিতে অবস্থিত মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কূটনীতির অধ্যাপক রবার্ট রোগোস্কি বলেন, তিনি আশা করেন, প্রথমে ট্রাম্প পিছু হটবে। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ওয়াশিংটনে এত বেশি পিছু হটা চলছে যে, এমনটি বিশ্বাস করা প্রায় কঠিন যে তারা আবারো পিছু হটবে না।
রোগোস্কি বলেন, শুল্কের প্রতি ট্রাম্পের ভুল মুগ্ধতা রয়েছে। তিনি পিছু হটেন কারণ, তিনি ধনী শ্রেণীর চাপে আছেন, যারা স্টক এবং বন্ড বাজারে বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারাচ্ছে। আর্থিক বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতা তার সমর্থনের ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শুক্রবার ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে, তারা চীনের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক থেকে প্রযুক্তি আমদানিকে অব্যাহতি দেবে। যদিও পরে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেন, এটি একটি অস্থায়ী অবসান এবং সেক্টরাল শুল্ক পাইপলাইনে রয়েছে। সোমবার ট্রাম্প জানান, তিনি তার ২৫ শতাংশ স্বয়ংক্রিয় শুল্ক থেকেও অব্যাহতি বিবেচনা করছেন।
রোগোস্কি বলেন, প্রতিটি পাবলিক পলিসি আলোচনারই কিছু স্তর থাকে: টেবিলের ওপারে যারা আছেন তাদের সাথে আলোচনা এবং আপনার পিছনে থেকে যারা আপনাকে সাহায্য করছেন তারা আলোচনার টেবিলে আসতে চান। তিনি আরও বলেন যে, এমন ক্ষেত্রে, ট্রাম্প প্রযুক্তি এবং অটো সেক্টরে বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সাথে “আলোচনা” করেন এবং “তাৎক্ষণিকভাবে হাল ছেড়ে দেন”।
রোগস্কির মতে, এমনটি হতে পারে যে, ট্রাম্প শিল্প নির্বাহীদের সমর্থন হারানোর ভয়ে তাড়িত হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু যে হয়েছে কেউ বেইজিংয়ে গিয়ে কথা বলার আগ পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। এবং বেইজিং বিষয়টি উপভোগ করছে। এ সময় রোগোস্কি ট্রাম্পকে ‘অজ্ঞ’ বলেও মন্তব্য করেন।
রোগোস্কি ট্রাম্পের হিট রিয়েলিটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'দ্য অ্যাপ্রেন্টিস' শো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কারণ, সেখানে তিনি একজন মধ্য-স্তরের উপস্থাপক ছিলেন, যার কোনো ক্ষমতা ছিল না, অন্যরা তাকে পরিচালনা করত।
মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ওয়েই লিয়াং-এর মতে, ট্রাম্পের নীতিগত সমন্বয়ের অভাব অন্যান্য স্তরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করছে।
চীনের ওপর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মনোযোগ ছিল কৌশলগত এবং তার মিত্রদের সাথে। কিন্তু ট্রাম্প সকলকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছেন বলে লিয়াং আল জাজিরাকে বলেন। তার মতে, স্বল্পমেয়াদে বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশগুলোকে সমন্বয় এবং সংকট ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে।
যদিও বেশিরভাগ দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত বিকল্প নেই। এতে করে ওয়াশিংটন সময় পাবে। দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদে সরাসরি 'আমেরিকা প্লাস ওয়ান' কৌশল তৈরি করার চেষ্টা করবে। লিয়াংয়ের মতে কারণটি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর নিরাপত্তা চুক্তির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাজার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৫
এমএইচডি/এমএম