ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

ফিচার

এক কাশ্মীরি শিল্পীর পরম্পরা ধরে রাখার লড়াই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১১, জুলাই ২৭, ২০২৫
এক কাশ্মীরি শিল্পীর পরম্পরা ধরে রাখার লড়াই সন্তুর তৈরির কাজ করছেন গোলাম মোহাম্মদ

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের সরু এক গলি। শান্ত এই গলিতেই ছোট্ট এক কারখানা।

এই কারখানা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে হারিয়ে যেতে বসা এক শিল্পকে।

এই ছোট্ট কারখানার ভেতরে বসে থাকেন গোলাম মোহাম্মদ জাজ। হাতে ‘সন্তুর’ নির্মাণ করতে পারা কাশ্মীরের শেষ জীবিত কারিগর হিসেবে পরিচিত তিনি।

সন্তুর একটি ত্রিকোণাকার তারযন্ত্র, দেখতে ডালসিমারের মতো, যা ছোট দুইটি কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। এটি স্বচ্ছ, ঘণ্টাধ্বনির মতো সুরের জন্য বিখ্যাত। বহু শতাব্দী ধরে এটি কাশ্মীরের সংগীতের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

গোলাম মোহাম্মদের পরিবার সাত প্রজন্ম ধরে কাশ্মীরের এই পরিচিত তারযন্ত্র তৈরি করে আসছে। ‘জাজ’ নামটি একসময় সমার্থক ছিল সন্তুর, রাবাব, সারেঙ্গী ও সেতারের কারিগরদের সঙ্গে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতে তৈরি যন্ত্রের চাহিদা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। মেশিনে তৈরি সস্তা যন্ত্রই এখন বাজার দখল করেছে। তার ওপর, কাশ্মীরি তরুণদের সংগীত রুচিরও আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

সংগীত শিক্ষক শাবির আহমদ মীর বলছিলেন, হিপ-হপ, র‍্যাপ আর ইলেকট্রনিক সংগীতের যুগে এখনকার প্রজন্ম আর ঐতিহ্যবাহী সংগীতের গভীরতা কিংবা সুরের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করে না। ফলে সন্তুরের ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে, এবং শিল্পীরা হারিয়েছেন বাজার।

গোলাম মোহাম্মদের কারখানার জংধরা যন্ত্রপাতি আর কাঠের খণ্ডগুলো যেন আজও কান পাতলেই শোনায় হাতুড়ির টুকটাক শব্দ। কিন্তু এখন সব কিছু স্তব্ধ, কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক বিলুপ্ত ঐতিহ্যের দীর্ঘশ্বাস।

কণ্ঠে বিষাদ নিয়ে তিনি বলেন, এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো আর কেউ নেই। আমিই শেষ মানুষ।

কিন্তু সময় এমন ছিল না। বহু খ্যাতনামা সুফি ও লোকসংগীতশিল্পী সন্তুর বাজিয়েছেন, যেগুলো তৈরি করেছেন গোলাম মোহাম্মদ নিজেই। তার দোকানে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ছবি, যাতে দেখা যায়, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও ভজন সোপোরি তার তৈরি সন্তুর বাজাচ্ছেন।

সন্তুরের উৎপত্তি সম্ভবত পারস্যে। সেখান থেকে এটি মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া পেরিয়ে ১৩ বা ১৪ শতকে ভারতে আসে। কাশ্মীরে এটি নতুন রূপে আবির্ভূত হয় এবং সুফি কবিতা ও লোকসংগীতের কেন্দ্রে জায়গা করে নেয়।

গানের শিক্ষক মীর বলছিলেন, প্রথমদিকে এটি সুফি সংগীতেরই অংশ ছিল, এবং সুরে ছিল লোকজ কোমলতা।

পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা পরে সন্তুরকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তুলে আনেন। তার কৌশলে যোগ হয় অতিরিক্ত তার, নতুন সেতু ও অভিনব বাজানোর পদ্ধতি। ভজন সোপোরি এতে সুফি অনুভবের গভীরতা যোগ করেন।

আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, ২০২২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছ থেকে পদ্মশ্রী পদক নিচ্ছেন গোলাম মোহাম্মদ। এটিই তার শিল্পের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।

চল্লিশের দশকে জিনা কাদাল এলাকায় জন্ম গোলাম মোহাম্মদের। এলাকাটি এক ঐতিহাসিক সেতুর নামে নামকরণ করা, যা একসময় কাশ্মীরি সংস্কৃতি ও ব্যবসার প্রাণ ছিল। শৈশবেই পরিবারিক কারখানায় তার বেড়ে ওঠা। কাঠের ঘ্রাণ, সুর আর হাতুড়ির শব্দ ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানতে হয় তাকে। তখনই বাবার হাত ধরে শুরু হয় সন্তুর তৈরির শিক্ষাযাত্রা। তিনি বলেন, তারা শুধু যন্ত্র বানাতে শেখাননি, শিখিয়েছেন, কীভাবে শুনতে হয়। কাঠের শব্দ, বাতাসের ধ্বনি আর ভবিষ্যতের সুরের আভাস কীভাবে ধরা যায়, তা।

তিনি বলেন, আমার পূর্বপুরুষদের রাজদরবারে ডাকা হতো, তাদের বলা হতো, মন শান্ত করার মতো যন্ত্র তৈরি করতে।

তার কর্মশালায় কাঠের একটি বেঞ্চে সারি সারি দেশীয় যন্ত্র ও তার, পাশে আধা-তৈরি সন্তুরের কঙ্কাল। বাতাসে ছড়ানো পুরোনো আখরোট কাঠের গন্ধ। আধুনিক যন্ত্রপাতির চিহ্নমাত্র নেই।

গোলাম মোহাম্মদ বিশ্বাস করেন, আধুনিক যন্ত্রে তৈরি সন্তুরে সেই উষ্ণতা নেই, নেই হৃদয়ছোঁয়া ধ্বনি। অডিও মানও অনেক দুর্বল।

সন্তুর তৈরির প্রক্রিয়া খুব ধীর, এটি বেশ ধৈর্যেরও কাজ। উপযুক্ত কাঠ বেছে নিতে হয়। তারপর খোদাই করে কাঠ ফাঁপা করা হয়, যাতে সুর প্রতিধ্বনিত হয়। প্রতিটি ব্রিজ সুনিপুণভাবে তৈরি ও বসানো হয়।

এরপর টানাতে হয় একশোরও বেশি তার। এসব তারের সুর মেলাতে লেগে যায় সপ্তাহ কিংবা মাস। গোলাম মোহাম্মদ বলেন, এটি ধৈর্য ও সাধনার কাজ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার তার কর্মশালায় এসে ছবি ও ভিডিও করেছেন, অনেকে নানা কাহিনি ছড়িয়েছেন নেটদুনিয়ায়।  

গোলাম মোহাম্মদ বলেন, এসব ঠিক আছে, কিন্তু এই কাজ সত্যিকারের উত্তরাধিকার পাবে কবে?

তিন মেয়ের কেউই এই পেশার ধার ধারেন না। সবাই অন্য পেশায়, ব্যস্ত জীবনযাপনে। ফলে পরিবারের ভেতরেই নেই কেউ, যিনি এই কারিগরি উত্তরাধিকার টিকিয়ে রাখবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার পথে এই শিল্প। যদিও মাঝেমধ্যে কিছু আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতায় তার ছায়াও মেলেনি।

কিন্তু গোলাম মোহাম্মদ বলেন, আমি খ্যাতি চাই না, করুণা চাই না। আমি চাই কেউ এই শিল্পটিকে ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে যাক।

এখন বয়স আশির কোঠায়, তবুও প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান আধা-তৈরি সন্তুরের পাশে, নীরবতায় শোনেন এক অসমাপ্ত সংগীতের ভাষা।

তিনি বলেন, এটি শুধু কাঠের কাজই নয়, এটি কবিতা, ভাষা। আমি যন্ত্রকে জিভ দিই, ভাষা দিই। সন্তুরের শব্দ আমি বাজানোর আগেই শুনতে পাই। এটিই রহস্য। আর এটিই আমি চাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাক।

বাইরের পৃথিবী যখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তার ছোট্ট কারখানায় তখনো সেই আলো-আঁধারির খেলা। তিনি গভীর স্বরে বলেন, যদি কাঠ আর সুরকে ধৈর্য আর সময় না দেওয়া হয়, তারা অবধারিতভাবেই নিস্তেজ হয়ে যাবে।

গোলাম মোহাম্মদ চান কেউ সত্যিকারের ভালোবাসার সঙ্গে এই শিল্পকে আগলে রাখুক। টাকার জন্য নয়, ক্যামেরার জন্য নয়—শুধু সংগীতের জন্য।

ভাষান্তর করেছেন: বাংলানিউজের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রকিবুল সুলভ

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।