ঢাকা, বুধবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৭

শিক্ষা

রাকসু নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি, উপাচার্যের হাতে ‘ক্ষমতার লাগাম’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪৪, অক্টোবর ১৪, ২০২৫
রাকসু নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি, উপাচার্যের হাতে ‘ক্ষমতার লাগাম’

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

ইশতেহারে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ, আবাসন সংকট নিরসন, খাবারের মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংস্কার; বাদ যায়নি কিছুই।

কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে রাকসুর গঠনতন্ত্র। এর সীমাবদ্ধতার কারণে প্রার্থীদের ইশতেহারের অনেকখানিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন হবে রাকসু সভাপতি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মাধ্যমে।

এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্যানেলগুলোর ইশতেহার বেশ উচ্চাভিলাষী। ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ বলছে, প্রশাসনকে ১০ বছরের অ্যাকাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে বাধ্য করা হবে এবং অ্যালামনাইদের সহায়তায় হল নির্মাণে তহবিল গঠন করা হবে। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ জানিয়েছে, তারা ১২ মাসে ২৪টি সংস্কারের কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ আবাসিক করার রোডম্যাপ, আবাসন ভর্তুকি এবং শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ।

অন্যদিকে, বামপন্থী ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী ফুয়াদ রাতুল তার ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১০ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা এবং ক্যাম্পাস শাটল সার্ভিস চালুর মতো দাবিগুলো সামনে এনেছেন।

প্রায় সব প্যানেল ও প্রার্থীই নিয়মিত রাকসু নির্বাচন এবং উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার মতো মৌলিক সংস্কারের কথা বলছেন।

প্রার্থীরা সংস্কারের আলাপ তুললেও, রাকসুর গঠনতন্ত্রে ভিন্ন কথা বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্রে ‘ক্ষমতা’ মূলত প্রশাসনের কাছে রাখা হয়েছে, বিশেষ করে উপাচার্যের হাতে। পদাধিকারবলে রাকসুর সভাপতি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

গঠনতন্ত্রের ৭(১)(ই) ধারা অনুযায়ী, সভাপতির (উপাচার্য) অনুমোদন ছাড়া নির্বাহী কমিটির কোনো সিদ্ধান্তই বৈধ হবে না। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করবে, তাদের নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ছাড়পত্র আসতে হবে উপাচার্যের দপ্তর থেকে।

এর চেয়েও শক্তিশালী ধারা হলো ৭(১)(সি)। এই ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য সংসদের ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ যেকোনো সময় যেকোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতে পারেন। এমনকি তিনি পুরো নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনেরও ডাক দিতে পারেন। কিন্তু এখানে ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ কী, তার কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। সুতরাং, প্রশাসনের সঙ্গে মতের অমিল হলে পুরো ছাত্র সংসদই ভেঙে দেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে রয়েছে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাকসুর ক্ষমতা বেশ সীমিত হলেও কিছু ক্ষেত্রে এর কার্যক্রমের সুযোগ রয়েছে। গঠনতন্ত্রের ধারা ২ ও ৭ অনুযায়ী, রাকসুর বিভিন্ন সম্পাদক— যেমন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, বিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক— নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম আয়োজন করতে পারেন।

সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের ‘হামদ, নাত ও কাওয়ালি’ আয়োজনের প্রতিশ্রুতি কিংবা অন্যান্য প্যানেলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক উৎসবের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নযোগ্য। কারণ, এসব কাজের জন্য বাজেট প্রণয়ন করে নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে অনুমোদন করানো সম্ভব। প্রকাশনা সম্পাদকের আওতায় ম্যাগাজিন বা জার্নাল প্রকাশ করাও রাকসুর ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে সেমিনার বা কর্মশালা আয়োজনের এখতিয়ারও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদকের রয়েছে। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন জোরদার করতে রাকসুর গঠনতন্ত্র বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

তবে আবাসন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা খাবারের ভর্তুকির মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মূল দাবি হলেও, এগুলো বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাকসু প্রতিনিধিদের হাতে নেই। তাই অনেকে রাকসু প্রতিনিধিদের বাস্তবায়নকারী নয়, বরং ‘চাপ প্রয়োগকারী’ হিসেবেই দেখছেন।

যেমন, সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ইশতেহারের শুরুতেই লেখা ছিল— গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্র প্রতিনিধিদের মেয়াদকাল ও কর্মপরিসর খুবই স্বল্প। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনে শুধু অবকাঠামোকেই উন্নয়ন হিসেবে হাজির করা হয়েছিল। এখনো আমরা পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুখরোচক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি শুনছি, যা ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।

তাই প্যানেলটি সরাসরি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, বিভিন্ন দাবিতে চাপ প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করেছে।

রাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রার্থীদের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ভিপিপ্রার্থী তাসিন খান বলেন, রাকসু আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন, কিন্তু এর গঠনতন্ত্র আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। আমরা যখন রাকসুকে শিক্ষার্থীদের সংগঠন হিসেবে কল্পনা করি, তখন দেখি নেতৃত্বের অধিকার সম্পূর্ণ ছাত্রদের হাতে নেই। উপাচার্য পদাধিকারবলে সভাপতি হন, অথচ আমাদের কণ্ঠ আমাদের প্রতিনিধি সেখানে অনুপস্থিত। এটা আমাদের কাছে বেশ অগণতান্ত্রিক মনে হয়।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের কোনো স্থায়ী সময়সূচি নেই। ফলে প্রশাসন যখন ইচ্ছা, তখন নির্বাচন স্থগিত করতে পারে। ছাত্রদের অধিকার যেন এক অনিশ্চয়তার খাঁচায় বন্দি। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ, নির্ধারিত নির্বাচনকাল, যেখানে ছাত্ররা জানবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন কবে হবে।

তাসিনের মতে, গঠনতন্ত্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলো সংশোধন না করলে রাকসু কখনোই প্রকৃত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে না। তাই তারা গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন।

প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো গঠনতন্ত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংস্কার। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের পথটা বেশ জটিল।

গঠনতন্ত্রের ধারা ১৬ অনুযায়ী, এটি সংশোধন করতে হলে রাকসুর মোট সদস্যের অর্ধেকের স্বাক্ষরসহ প্রস্তাব জমা দিতে হবে। এরপর সাধারণ সভায় মোট সদস্যের ৭৫ শতাংশ উপস্থিতিতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা পাস করাতে হবে।

রাকসুর গঠনতন্ত্রে প্রশাসনের সর্বময় ক্ষমতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এফ নজরুল ইসলাম বলেন, সামনে নির্বাচন। আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে কথা বলি। প্রার্থীদের যদি গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্যা হয়, তাহলে তাঁরা নির্বাচিত হওয়ার পর গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নিতে পারবেন।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।