ক্রমে বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির অবনতি থেকে ক্রমোন্নতির মধ্যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশে এখন মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১.৩১ বিলিয়ন বা তিন হাজার ১৩১ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
রোববার (২৯ জুন) সন্ধ্যায় এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবারই গোপন রিজার্ভ বা নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) তথ্য প্রকাশ করলো বাংলাদেশ ব্যাংক। যাকে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ বলা হয়। এ রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৩১ বিলিয়ন ডলার। দেশের এই ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এই মাইলফলক তৈরি হয়েছে রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকার কারণে। একক বছর হিসাবে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে। গত কয়েকদিনের মধ্যে আইএমএফ-এর ঋণের দুই কিস্তির অর্থ ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। এডিবির ঋণের অর্থ পাওয়া গেছে ০.৯ বিলিয়ন ডলার, জাইকা থেকে পাওয়া গেছে ০.৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং ০.৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে এআইআইবি থেকে। সবই এসেছে জুন মাসের শেষ কয়েকদিনে। মানি লন্ডারিংসহ টাকার পাচার রোধে অভিযান চলার কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার এই মাইলফলক তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বাংলানিউজকে বলেন, এ সময়ে প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফন হয়েছে। অন্যান্য বছরে যখন কোনো ইভেন্ট থাকে তখন প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়। তারপর আবার কমে। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল, আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ছিল যাতে ওভার ইনভয়েস করে টাকা বাইরে চলে না যায়, মানি লন্ডারিং না হয়— এটা বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে— তোমাদের আমদানি তোমাদের সামাল দিতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সহায়তা করবে না এবং করেনি। সর্বশেষ আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের যেসব শর্ত ছিল, সেগুলো মেনে নেওয়ার কারণে দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে জুনের শেষের দিকে অল্প সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে। এই সবকিছুর একটি সমন্বিত ফল এটি।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠানো বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই বাড়তি প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফেরায়। এর ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমে যায়। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১০ মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করছে না। এর মধ্যে দেশের ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কার, বাজেট সহায়তা ও ঋণ হিসেবে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নীতিমালাও বৈদেশিক মুদ্রার নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
করোনা মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে দেশের রিজার্ভ উঠেছিল সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে (চার হাজার ৮০০ কোটি)। করোনা পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি ও আমদানি শুরু হলে দ্রুত কমতে থাকে রিজার্ভ। এ সময় দেশ বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়ে। ডলারের বিপরীতে টাকার দর অবনমন হতে থাকলে প্রভাব পড়ে জ্বালানির দামে ও আমদানিতে। সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে রিজার্ভের পরিমাণ তলানিতে নামে। ওই সময় রিজার্ভ বাড়াতে বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়ে ২০২২ সালের জুলাইতে আবেদন করে।
এরপর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। মোট ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের মধ্যে বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ১৪০ কোটি ডলার অন্তর্ভুক্ত।
বৈদেশিক মুদ্রার এই উচ্চতায় উন্নীত হওয়া সব উদ্যোগের সম্মিলিত ফল। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে সংশয় ও ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে রিজার্ভের তলানির যে পরিস্থিতি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছিল, রিজার্ভের এই নতুন উচ্চতায় সেই ইমেজ সংকটও কেটে গেছে।
জেডএ/এমজে