*এক সপ্তাহে মূলধন কমল ১০ হাজার কোটি টাকা *অনিশ্চয়তায় আস্থার সংকট বাড়ছে *তিন মাস আগের অবস্থানে ডিএসইর সূচক
দেশের পুঁজিবাজারে পতনের ঝড় থামেনি। আস্থাহীনতাও চরমে।
দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সরিয়ে একটি স্থিতিশীল ও আস্থার বাজারে পরিণত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দেখা যায়নি। ফলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূচকের বড় বড় পতনের রেকর্ড করেই যাচ্ছে। গতকালও সূচকের ‘কফিনে আরেকটি পেড়েক’ বসল। এদিন সূচকের পতন হয়েছে ৮১ পয়েন্ট।
এ নিয়ে টানা পাঁচ কার্যদিবস বাজারে দরপতন ঘটল। বিনিয়োগকারীদের মতে, সংকটের মূল কারণ হলো দুর্বল ও তারল্য সংকটে ভোগা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত এবং ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধের প্রক্রিয়া। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পুঁজির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন, যার ফলে বাজারে বিক্রয় চাপ বেড়েছে এবং মূলধন আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে অনেক বিনিয়োগকারী ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ কৌশল নিয়েছেন।
আসন্ন আর্নিং সিজনেও (আয়ের মৌসুম) বিনিয়োগকারীরা নতুন পজিশন নিতে সতর্ক ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটির প্রস্তাবিত নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, এই একীভূতকরণে পুরনো ব্যাংকগুলোর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতিপূরণ থাকবে না। ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর অধীনে নতুন ব্যাংক তালিকাভুক্ত হলেও বর্তমান শেয়ারগুলো সেখানে স্থান পাবে না।
অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বহু বছরের বিনিয়োগ কার্যত শূন্য হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একীভূত ব্যাংকের শেয়ার নতুন করে ইস্যু করা হবে এবং পুরনো শেয়ারহোল্ডাররা এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন না। এই ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে বাজারে।
বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে বিএসইসির চিঠি: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গত সপ্তাহে বিএসইসি গভর্নরের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে কমিশন বলেছে, এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক সংকট বা অনিয়মের জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দায়ী নন, অথচ তাঁদের বিনিয়োগের অর্থ শূন্য হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে-এটি অনৈতিক ও অযৌক্তিক। বিএসইসি চারটি প্রস্তাব দিয়েছে-প্রথমত, ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স, ব্র্যান্ড ভ্যালু, ক্লায়েন্ট বেইসসহ সব সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করে শেয়ারহোল্ডারদের অংশ নির্ধারণ করা; দ্বিতীয়ত, দায়ী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্পদ ক্রোক করে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করা; তৃতীয়ত, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে ‘ন্যূনতম স্বার্থমূল্য’ হিসেবে ধরা এবং চতুর্থত, চূড়ান্ত মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তালিকাচ্যুত না করা।
বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে যেন আইন অনুযায়ী সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার সংরক্ষিত থাকে। তাঁরা দায়ী না হয়েও যেন ক্ষতির মুখে না পড়েন। ’
একীভূতকরণের ঘোষণার পর টানা দরপতন: একীভূতকরণের ঘোষণা আসার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দামে ভয়াবহ পতন ঘটে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর গত বছরের শেষে ছিল পাঁচ টাকা ৪০ পয়সা, যা এখন কমে মাত্র এক টাকা ৯০ পয়সায় নেমেছে-পতন প্রায় ৬৫ শতাংশ। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর আট টাকা ৮০ পয়সা থেকে নেমে এসেছে চার টাকা ৭০ পয়সায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার ৬৫.১৩ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকে ৩৯.২৮ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ৩১.৮১ শতাংশ। এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লাখো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর পুঁজি জড়িত, যার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত হলে এই বিপুল বিনিয়োগ মূল্যহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে একীভূতকরণ প্রয়োজন হতে পারে, তবে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির দায় সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না। বাজারে আস্থা ফেরাতে হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিষয়টি পরিষ্কার না করে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত বাজারকে সামগ্রিকভাবে পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা এই মার্জার-প্রক্রিয়ায় ডিবিএকে সঙ্গে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। ’
বাজার পর্যালোচনা: এদিকে গতকালের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে যে কয়টি শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে, তার চেয়ে সাত গুণের দরপতন হয়েছে। এতে এক্সচেঞ্জটির সব মূল্যসূচক এক দিনেই প্রায় ২ শতাংশের কাছাকাছি কমেছে। এর মধ্যে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স তিন মাস আগের অবস্থানে নেমেছে। তবে এক্সচেঞ্জটির লেনদেনের পরিমাণ সামান্য বেড়েছে।
ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮১ পয়েন্ট বা ১.৫৪ শতাংশ কমে ৫২০২ পয়েন্টে অবস্থান করেছে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সিএসইর সার্বিক সূচক সিএসপিআই ১৮৫ পয়েন্ট কমে ১৪৭৬২ পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে।
গত সপ্তাহে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১৩২ পয়েন্ট বা ২.৪৪ শতাংশ এবং বাজার মূলধন কমেছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে পুরো মাসে সূচক কমেছে ৩.২০ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যতম দুর্বল পারফরম্যান্স হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল পারফরম্যান্স বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের: খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতির কিছু সূচক ইতিবাচক থাকলেও পুঁজিবাজারে এর প্রভাব পড়েনি। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১১.৬৯ শতাংশ, রপ্তানি আয়ও বেড়েছে, কিন্তু ব্যাংক খাতের অনিয়ম, বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল পারফরম্যান্স করেছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। টানা তিন মাসের উত্থানের পর মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতায় ডিএসইএক্স সূচক ৩.২০ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া মাসের সেরা পারফরমার হিসেবে ১০ শতাংশেরও বেশি রিটার্ন অর্জন করেছে। এর পরই রয়েছে তাইওয়ান (৯ শতাংশ) ও পাকিস্তান (৭.৩৪ শতাংশ)।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
এসআই