ঢাকা: বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ আগামীকাল সোমবার। এরইমধ্যে নতুন বছরকে বরণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই।
পহেলা বৈশাখ এলেই বিক্রেতারা বাড়তি মুনাফা করতে নেমে পড়েন প্রতিযোগিতায়। এবারো ব্যতিক্রম নয়। ইচ্ছেমতো দাম হাঁকানো হচ্ছে ইলিশের। পরিস্থিতি এমন— যত বড় ইলিশ, দামও তত বেশি।
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখে পান্তার সঙ্গে খেতে উচ্চবিত্তরা ইলিশ কিনছেন শখে। সেই ইলিশই মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের পাতে উঠছে না দামের কারণে। পহেলা বৈশাখের আগে এই দুই শ্রেণির লোকজন ইলিশের দাম শুনে রীতিমতো হতাশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলেদের জালে এখন ইলিশ খুব কম ধরা পড়ছে। এজন্য দাম আগের তুলনায় একটু বেশি। এ ছাড়া এখন জাটকা সংরক্ষণের জন্য নিদিষ্ট মাপের জাল ব্যবহার করছেন জেলেরা। সে কারণে ইলিশের দেখা মিলছে না।
অন্যদিকে ক্রেতা-ভোক্তারা ইলিশের বাড়তি দামের জন্য অসাধু চক্রের কারসাজিকে দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইলিশের দাম বাড়াচ্ছে। নইলে ইলিশ মাছের এত দাম কেন হবে?
রোববার রাজধানীর সূত্রাপুর, রায়সাহেব বাজার ও নয়া বাজারে ও ধূপখোলা মাঠ বাজারে গিয়ে ইলিশের দরদামের খোঁজ নিয়েছেন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক। বাজারগুলোতে টাটকা ইলিশের তুলনায় হিমায়িত ইলিশ বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে হিমায়িত ইলিশের চেয়ে টাটকা ইলিশের দাম অনেক বেশি।
টাটকা এক কেজি বা একটু বেশি ওজনের ইলিশের দাম চাওয়া হচ্ছে তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। আর ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের দাম দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকা। ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা।
এক কেজি বা এর বেশি ওজনের হিমায়িত ইলিশের দাম দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা। আর ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের হিমায়িত ইলিশের দাম এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। আর ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রামের দাম এক হাজার ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা। দরদাম করে কিনলে দুই-একশ টাকা কমেও কেনা যাচ্ছে।
নয়াবাজারে ইলিশ কিনতে আসা আল-আমিন অনেকটা হতাশা নিয়েই বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশের দামের এ অবস্থা কেন? গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদনও বাড়ছে ইলিশের। কিন্তু বেশি দামের কারণে এই মাছের স্বাদ নিতে পারছেন না সাধারণ ক্রেতারা। এই মাছতো চাষ করতে হয় না, নেই উৎপাদন খরচও। তারপরও কয়েক বছর ধরে নাগালের বাইরে ইলিশের দাম।
একই বাজারে মাছ কিনতে আসা মো. জসিম বাংলানিউজকে বলেন, বিক্রেতাদের কারসাজিতে কয়েক বছর ধরে ইলিশের দাম বাড়ছে। দাম বাড়িয়ে বিক্রেতারা ইচ্ছা করেই ইলিশকে উচ্চবিত্তের খাবারে পরিণত করেছে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ কিনতে পারছি না। আর পহেলা বৈশাখ ঘিরে একটি মাছ কিনতে এসে দেখি দাম আকাশচুম্বী। সেজন্য ইলিশ না নিয়েই বাড়ি ফিরছি।
ধূপখোলা মাঠ বাজারে ইলিশ কিনতে আসা মো. নাবিল নামে এক ক্রেতা বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশ যে আমাদের দেশের মাছ, দাম শুনে তা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। পহেলা বৈশাখে পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে পান্তা-ইলিশ খাব, তাই ইলিশ কিনতে এসেছি। বাজারে পদ্মার ইলিশ নেই বললেই চলে। যা-ও মিলছে, সেগুলোর দামও চড়া। অন্য এলাকার ইলিশে তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না, তাই পদ্মার ইলিশের চাহিদা বেশি।
বিক্রেতারা বলছেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাজারে ইলিশের চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে। তবে বাজারে এখন যেসব ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই হিমায়িত ইলিশ। সেগুলো স্বাদ ও গন্ধ কম। তাই দাম ও একটু কম। তবে টাটকা বা ফ্রেস ইলিশের চাহিদা যেমন বেশি, দামও বেশি।
নয়াবাজারের ইলিশ বিক্রেতা সূধন্য রাজবংশী বাংলানিউজকে বলেন, কাল পহেলা বৈশাখ। তাই আজ ইলিশের চাহিদা আছে। সেজন্য মাওয়া ঘাট থেকে টাটকা ইলিশ এনেছি। ঘাটে ইলিশের অনেক দাম, হাত দেওয়া যায় না। আমার কাছে সব সময় পদ্মার ইলিশই পাবেন। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে থেকে তিন হাজার ৫০০টাকা, মাঝারি দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা, ছোট এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমার কাছে বরফ ছাড়া মাছ পাবেন।
একই বাজারে ইলিশ বিক্রি করেন ভগীরথ বর্মণ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রাবাড়ি থেকে ইলিশ এনেছি। আমার কাছে সব হিমায়িত ইলিশ। টাটকা ইলিশের দাম বেশি। ক্রেতারা দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। সেই তুলনায় হিমায়িত ইলিশের দাম কম। ক্রেতারাও খুশি, আমিও খুশি। এখন বাজারের সব মাছ কোল্ডস্টোরেজের। যেহেতু এ সময় জাটকা ধরা নিষিদ্ধ তাই টাটকা মাছ কম। তবে সরকারের নির্দেশনা নামে আছে কাজে নেই। জায়গা মতো মনিটরিং করতে হবে।
সূত্রাপুর বাজারের ইলিশবিক্রেতা নিরঞ্জন দাস বলেন, পহেলা বৈশাখ ঘিরে চাহিদা বাড়ায় বেচাকেনা বেড়েছে। বাজারে পদ্মার ইলিশের দাম চড়া। প্রতি কেজি তিন হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্যান্য এলাকার ইলিশ কিছুটা কম দামেই বিক্রি হচ্ছে।
ধূপখোলা মাঠ বাজারের ইলিশ বিক্রেতা রতন বর্মণ বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েক দিন ধরে ঘাটে ভালো ইলিশ পাইনি। তাই বিক্রিও কম। আজ তো কোনো ইলিশ পাইনি। সেজন্য দোকানও লাগাই নি। বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার কিছু বান্ধা কাস্টমার আছে, তাদের খারাপ ইলিশ দিলে আর আমার কাছে আসবে না। এক দিন বিক্রির জন্য সারা বছরের বিক্রি তো আর বন্ধ করতে পারি না। বাজারে বেশির ভাগই ফ্রিজ করা ইলিশ মাছ। এ মাছের স্বাদ-গন্ধ নেই। দামও অনেক।
পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চর্চা ‘বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়’: উপদেষ্টা ফরিদা
এ বছর পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। সোমবার (৭ এপ্রিল) দুপরে সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন তিনি এ আহ্বান জানান।
জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ -২০২৫ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে উপদেষ্টা চৈত্র সংক্রান্তি পালনের সঙ্গে পহেলা বৈশাখে বাতাসা, দই, চিড়া, মিষ্টি, ছাতুর সরবত, ভাত, শাক, সবজি ইত্যাদি খাওয়ার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, মানুষ পহেলা বৈশাখে ইলিশ খায় কেমন করে। এ সময় তো ইলিশ পাওয়ার কথা নয়। পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। এটি আমি পরিষ্কার করতে চাই।
তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখে যারা ইলিশ খাবেন, তারা জাটকা-ই খাবেন। একই সঙ্গে তারা আইন লঙ্ঘন করবেন। কাজেই বাজারে পাওয়াটাও আইনের লঙ্ঘন হয়। এই সময়ে আমরা জোরালোভাবে জাটকা সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতন করার জন্য আমরা বলেছি।
মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেছেন, এবার যেন জুন মাসের পরে যখন ইলিশ বাজারে আসবে, তখন যেন দামটা ঠিক থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তা না হলে জনগণ আমাকে ক্ষমা করবেন না।
ইলিশ আসে কয়েক হাত ঘুরে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী বা সাগর থেকে ইলিশ আহরণের পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে কয়েকটি হাত ঘুরে বেড়ায়। আর এই সময়েই ইলিশের দাম বেড়ে যায়। যে ইলিশ যত বড়, তার দর তত বেশি। অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুত করেও ইলিশের দাম বাড়িয়ে দেন বলেও অভিযোগ আছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইলিশ পাচার হয় কি না, তাও খতিয়ে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ মৎস্য করপোরেশনের (বিএফডিসি) এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মাস দুয়েক আগে সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি সাগর থেকে সরাসরি ইলিশ কিনে রাজধানীতে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন অনেক কম দামে ভোক্তারা ইলিশ মাছ খেতে পেরেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছে কিনতে গেলে দাম হয় আকাশচুম্বী। অর্থাৎ এখানে কারসাজি আছে। তার ভাষ্য, কারসাজি ভাঙতে সরকারকে কাজ করতে হবে।
দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ ইলিশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় এক শতাংশ। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ লাখ টনের বেশি।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন পাঁচ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৫
জিসিজি/আরএইচ