ব্রাজিলীয় পত্রিকা আ নোভা ডেমোক্রাসিয়া-কে দেওয়া এক শক্তিশালী সাক্ষাৎকারে লেবাননে জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনি মুই থাই (থাই মার্শাল আর্ট) ফাইটার জেনিন নাসিরি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রীড়াজগতের ভূমিকা এবং নিজের রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলেন।
ছোটবেলা থেকেই পরিবারের অনেক সদস্যকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হতে দেখেছেন নাসিরি।
২০২৪ সালের মার্চে থাইল্যান্ডে এক লড়াইয়ের পর দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘এই রক্ত আমি ইচ্ছা করে ঢেলেছি, কিন্তু আমার মানুষগুলো কোনো কারণ ছাড়াই খুন হচ্ছে। গাজার শিশুদের না খাইয়ে মারছে ওরা। ‘
সাক্ষাৎকারে নাসিরি বলেন, ‘খেলাধুলা এমন এক ক্ষেত্র যেখানে সারা দুনিয়ার মানুষ নজর রাখে। অনেকেই গাজা গণহত্যার আগেও ফিলিস্তিনের কথা জানতেন না। কেউ কেউ ভাবতেন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল আলাদা আলাদা দেশ, জানতেন না এই দেশটিকে দখল করে নিয়েছে ইসরায়েলিরা। তাই খেলাধুলার মাধ্যমে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আমাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। ‘
তিনি জানান, ‘মুই থাই যারা দেখে তাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনের পক্ষে। আমার পাশের সাধারণ পশ্চিমা বন্ধুরাও এখন ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নেয়। ‘
তবে তার মতে সবচেয়ে আন্তরিক সমর্থন আসে আয়ারল্যান্ড থেকে, ‘আমি আয়ারল্যান্ডবাসীদের খুব ভালোবাসি। তারা শুধু নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রতি নয়, যারা প্রতিরোধ করছে তাদের প্রতিও সমর্থন জানায়। এটা অনেকের চেয়ে আলাদা, যারা শুধু তখনই পাশে দাঁড়ায় যখন তুমি মরছো, লড়ছো না। ‘
সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের এমএমএ (মিশ্র মার্শাল আর্ট) ফাইটার প্যাডি ম্যাককোরি ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত শুকি ফারাজেকে হারানোর পর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘ফ্রি ফিলিস্তিন’ বলে চিৎকার করলে তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললে মূল্য দিতে হয়—এ কথা অকপটে স্বীকার করেন নাসিরি। একবার এক আয়োজক তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল নিয়ে অভিযোগ করে বলেন, ‘তোমার ফিলিস্তিন সংক্রান্ত পোস্ট অনেক বেশি। ’
থাইল্যান্ডে তার বক্তৃতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়। তিনি বলেন, “কিছু দেশের পক্ষ থেকে হয়রানি হয়েছে। ইন্টারনেটে ভিডিও ঘুরছে, আমাকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে—আমার মতো মানুষরা ইংল্যান্ডে থাকায় তারা ‘নিরাপদ’ বোধ করছে না। ”
তিনি এখন যুক্তরাজ্যে থাকেন, তবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার কারণে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু তাতেও নানা সমস্যা থেকে মুক্তি মেলেনি বলে জানান তিনি, ‘কিছু ফাইট বাতিল হয়েছে, কিছু জায়গা থেকে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, দুটি জিম ছেড়ে দিতে হয়েছে। অনেক সময় কেউ কিছু না বলেই ট্রেনিংয়ে আসা বন্ধ করে দেয়, টাইম স্লট দেওয়া বন্ধ করে দেয়—হঠাৎ বুঝতে পারি, এসব আমার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। ’
তবুও তিনি বলেন, ‘এসব আমার কিছু যায় আসে না। আমার মানুষ খুন হচ্ছে, আমি এক-দুটি ফাইট না পেলে কী এসে যায়! আমি অন্য কোথাও গিয়ে লড়ব। ফিলিস্তিন আমার ক্যারিয়ারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’
প্রতিরোধই একমাত্র পথ
নাসিরির বিশ্বাস, প্রতিরোধই একমাত্র পথ। তার ভাষায়, ‘ইতিহাস দেখলে বুঝবেন, কোনো দেশ কেবল জাতিসংঘ বা নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তে স্বাধীনতা পায়নি। শান্তিপূর্ণ মিছিলে কোনো জমি মুক্ত হয়নি। দেখুন, অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের ২২ শতাংশ ভূমির কথা ছিল। কিন্তু তারা পেয়েছে ১০ শতাংশেরও কম। এখন কী হলো?’
তিনি বলেন, ‘অক্টোবর ৭-এর পর থেকেই পশ্চিম তীরে সবচেয়ে বেশি শিশু নিহত হয়েছে। ওরা গ্রেপ্তার করে, ঘরে ঢুকে পড়ে, মসজিদ ও গির্জায় হানা দেয়। যদি কেউ আমাদের আক্রমণ করে, তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার শক্তি আমাদের থাকতে হবে। আর সেটা প্রতিরোধ ছাড়া সম্ভব নয়। ’
“একটা ফিলিস্তিনি র্যাপ গান আছে, যেখানে বলা হয়: ‘আমি শান্তির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু শান্তি আমার বিরুদ্ধে। কারণ শান্তি ন্যায়সঙ্গত হতে হবে। ’ আমি গর্বিত যে আমি ফিলিস্তিনি। এই গর্ব তাদের কারণে যারা লড়ছে—যারা আমাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করছে। ”—যোগ করেন তিনি।
অবশেষে নাসিরি বলেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনিরা একটা বার্তা দিতে চাই—আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর বিশ্বাস করি না, জাতিসংঘের ওপর বিশ্বাস করি না, এই ভুয়া তথাকথিত সভ্য দেশগুলোর ওপর বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি শুধু আমাদের প্রতিরোধের ওপর। ’
এই বক্তব্যের সময় দর্শকরা দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল—‘ফ্রি ফিলিস্তিন!’
অনুবাদ: দি প্যালেস্টাইন ক্রনিকল অবলম্বনে
এমএইচএম