ঢাকা, বুধবার, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১৮ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

রাজনীতির গৌরব পুনরুদ্ধারে যশোর-৩ আসনে বিএনপির কান্ডারি অমিত, জামায়াতের প্রার্থী কাদের

সরোয়ার হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪৫, আগস্ট ১৩, ২০২৫
রাজনীতির গৌরব পুনরুদ্ধারে যশোর-৩ আসনে বিএনপির কান্ডারি অমিত, জামায়াতের প্রার্থী কাদের যশোর-৩ আসনে বিএনপি প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জামায়াতের আব্দুল কাদের

যশোর: তিনবন্ধু, ত্রিরত্ন, যশোরের রাজনীতির স্তম্ভ-কত ভাবেই না অভিহিত করা হতো তাদের। তারা ছিলেন যশোরের রাজনীতির মহিরূহ।

সত্যিকারের রাজনীতিক হিসেবে তৃণমূল থেকে দেশের রাজনীতির শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছিলেন সবাই। যশোরের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা এই তিন বন্ধু একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাজনৈতিক ময়দানে। জাতীয় নির্বাচনে তাদের অংশ গ্রহণ যশোর-৩ (বসুন্দিয়া বাদে সদর উপজেলা) আসনকে সত্যিকারের ভিআইপি’র মর্যাদা দিয়েছিল।  

জননন্দিত এই তিন বন্ধু হলেন প্রয়াত তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো এবং আলী রেজা রাজু। নিজেদের জীবদ্দশায় তারা দেখেছেন যশোরের রাজনীতির অধঃপতন। ব্যক্তিগতভাবে যার শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। দেখেছেন যশোরের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র সদর আসনটিকে আওয়ামী লীগ অরাজনৈতিক নেতার হাতে তুলে দিয়েছে।

সে কারণে আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচন হয়ে উঠেছে দলীয় সামর্থ প্রমাণের পাশাপাশি যশোর-৩ আসনের পুরনো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের লড়াইও। অগ্রভাগে থেকে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। এই আসন থেকে তিনিই দলের একক প্রার্থী। তার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণা করেছে যশোর সরকারি এম এম কলেজের সাবেক ভিপি আব্দুল কাদেরকে।  

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। রয়েছেন এনসিপির প্রার্থীও, তবে এখনো দলটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি।  

বৃটিশ-ভারতের প্রথম তিনটি জেলার মধ্যে যশোর অন্যতম। তেভাগা আন্দোলন, নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, মহান ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যশোরের অবদান অনস্বীকার্য। এটি মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলাও। যশোর সদর আসনের অন্তর্গত ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা। এরশাদ স্বৈরাচার এবং হাসিনার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনেও যশোরের অবদান কেউ ভুলতে পারবে না। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তীর্থ ভূমিও বলা হয় যশোরকে। কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই জেলার ইতিহাস ও ঐহিত্য গৌরবের। জাতীয় রাজনীতিতেও যশোরের অবদান অসামান্য। আর এর সবই আবির্ভূত হতো জেলা সদর থেকে। যা বর্তমানে যশোর-৩ আসনের অন্তর্গত। স্বাধীনতার পর এটি ছিল তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলার যশোর-৯ আসনভুক্ত।

১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য রওশন আলী। মাত্র দুই বছরের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করার পর তিনি তাতে যোগ দিয়ে জেলার গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরপরই যশোরের ক্ষমতার রাজনীতিতে আবির্ভুত হতে থাকেন তিন বন্ধু। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে বিএনপি থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন তরিকুল ইসলাম। যশোর এমএম কলেজের ভিপি থেকে সরকারের মন্ত্রী-সবই হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও এই আসন থেকে তরিকুল ইসলাম ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং ২০০১ এর নির্বাচনেও এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন বিএনপির মতো শীর্ষ দলের মহাসচিব ও চেয়ারম্যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।  

তরিকুল ইসলামের বাল্যবন্ধু খালেদুর রহমান টিটোও ছিলেন জাতীয় রাজনীতিক। তিনি ১৯৭৪ সালে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে গণতান্ত্রিক পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে যশোর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন টিটো। ছিলেন যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান। জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরশাদের মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

তাদের আর এক বন্ধু আলী রেজা রাজু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে এমপি হয়েছেন। মাঝে পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদেরও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি বৃহৎ দুটি রাজনৈতিদ দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগে দীর্ঘ সময় ধরে জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যশোর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হন। এছাড়া, এই আসন থেকে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন জাসদের আব্দুল হাই।  

পাতানো নির্বাচন শুরুর সাথে সাথেই যশোর-৩ আসনকে অরাজনৈতিক নেতার হাতে তুলে দেওয়ার মিশন শুরু করে আওয়ামী লীগ। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের কথিত নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা তুলে দেয় কাজী নাবিল আহমেদের হাতে। এমপি হওয়ার আগে তিনি কখনো রাজনীতির ময়দানেই ছিলেন না। কথিত আছে যশোর-৩ আসনটি পারিবারিক ভাগবাটোয়ারায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার কোটায় পড়েছিল। সেই সুবাদে বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি বার বার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বঞ্চিত করে আসনটি ব্যবসায়ী কাজী নাবিল আহমেদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।  

‘বলা চলে, যশোরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধস চূড়ান্ত রূপ নেয় সেই সময় থেকেই। ভিআইপির মর্যাদা আর থাকে না যশোর-৩ আসটির। এখানে জন্ম নেয় এক নব্য শোষক আর রাজনৈতিক আলখেল্লায় মোড়ানো তার পোষ্য কর্মী বাহিনী’-বলেন যশোর জেলা জাতীয়তাবাদী যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আরিফ।  

তিনি বলেন, হারানো রাজনৈতিক গৌরব পুনরুদ্ধারে যশোরের এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।  

ফ্যাসিবাদ উত্তর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে উঠেছে যশোরের রাজনীতির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো। এখানে বিএনপির এক এবং একক কান্ডারি দলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। নির্ভার থেকেই তিনি সামগ্রিক দলীয় রাজনীতির পাশাপাশি নির্বাচনী ময়দানও সামলে চলেছেন।  

অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘যশোরের রাজনীতির একটা সৌন্দর্য্য ছিল। এখানে রাজনৈতিক সহাবস্থান, সামাজিক সম্প্রীতি ছিল। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও পথের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক ভিন্নতা কখনোই মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করতো না। কারণ, তখন রাজনীতি করতেন রাজনীতিকরাই’।

তিনি বলেন, ‘যশোরের রাজনীতির সেই সৌন্দর্য গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কও রাখেনি তারা। সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির জায়গায় তারা হিংসার আগুন জ্বালিয়েছে। এমনকী কারো বিয়েতে পর্যন্ত ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতারা দাওয়াত পর্যন্ত পাননি’।
অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি যে কথা বলেছি, এখনো সেই কথা বলবো। বিএনপি যশোরের রাজনৈতিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে চায়। হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করে ব্যক্তি ও সামাজিক সহাবস্থান যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেই কাজ করতে চায়’।

এক্ষেত্রে, ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি সব সময় বড় দল হিসেবে যতটুকু সম্ভব উদারতা দেখিয়েছে এবং ছাড় দিয়েছে-বলেন অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।  

তিনি বলেন, আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং দল যাকেই মনোনয়ন দেবে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী তাকে বিজয়ী করতে জানবাজি রেখে কাজ করতে প্রস্তুত হয়ে আছে।

অন্যদিকে, অমিতের বিরুদ্ধে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী আব্দুল কাদের। যশোর এমএম কলেজের সাবেক এই ভিপি বর্তমানে গার্মেন্টস ব্যবসায় যুক্ত আছেন। তিনি ব্যবসায়িক কাজে ঢাকাতে বেশি থাকেন। তবে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে জেলায় বেশি সময় ব্যয় করছেন।

বাংলানিউজকে আব্দুল কাদের বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে যশোরে কোনো রাজনৈতিক চর্চা হয়নি। অতীতের গৌরব পুনরুদ্ধারে আমরা (জামায়াত) প্রস্তুত। যশোরকে নতুন করে গড়তে চাই। সেজন্য বিভেদ আর সংঘাতের বিরুদ্ধে বলছি। ’

তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে সংগঠন গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেছেন তারা। সেই সাথে জনসংযোগ এবং সামাজিক কার্যাবলী চালিয়ে যাচ্ছেন।

যশোর-৩ আসনে এখনো পর্যন্ত আর যেসব প্রার্থীর কথা শোনা যাচ্ছে তারা হলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য খালিদ সাইফুল্লাহ জুয়েল, খেলাফত মজলিসের হাফেজ আব্দুল্লাহ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা সোয়াইব হোসেন।  

খালিদ সাইফুল্লাহ জুয়েল বাংলানিউজকে বলেছেন, যশোর সদর এলাকার সন্তান হিসেবে তিনি এই আসন থেকেই নির্বাচন করতে চান। তবে, কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। খেলাফত মজলিস এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজেদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে।

এসএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।