চাঁদপুর: চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার গন্ধর্ব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের মৈশামুড়া গ্রামের বড় বাড়ির আমিন মিয়ার ছেলে শহীদ হান্নান। গত বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি।
শহীদ হান্নান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯২ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাবা আমিন মিয়া (৯৫) ও মা রাশিদা বেগমের (৭৫) ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ভাইদের মধ্যে বিল্লাল হোসেন (৫৫), ইমান হোসেন (৪৯), রফিক (৪৩), মান্নান (৪০) ও একমাত্র বোন বিউটি (৩৭)। বোন বিবাহিত ও গৃহিণী। ভাইদের চারজনই ঢাকার বিভিন্ন বেকারিতে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন। হান্নান পড়াশোনা করেছেন মৈশামুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত।
২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি হান্নান বিয়ে করেন বিবি হাওয়া মুক্তাকে (২০)। শ্বশুর ওমানপ্রবাসী মো. স্বপন (৫২) ও শাশুড়ি নাজমা বেগম (৪৫) গৃহিণী। মুক্তাদের গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার কাশিমপুর উটনী গ্রামে। মুক্তার বড় বোন সুমাইয়া (২৫) বিবাহিত, ছোট বোন নুসরাত (১৫) নবম শ্রেণিতে পড়ে ও একমাত্র ভাই আহমেদ নাবিল (১০) মাদরাসায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
হান্নান ও তার ভাই রফিক ঢাকার মধ্য বাড্ডার পূর্বাঞ্চলের ৯ নম্বর রোডের ‘আপনজন বেকারি’তে বিক্রয়কর্মী ছিলেন। প্রথমে রফিক কাজ শুরু করেন, এরপর চার বছর আগে হান্নান যোগ দেন। বেকারির পাশে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় চারজন মিলে ভাড়া থাকতেন, সবাই একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী।
হান্নানের বড় ভাই রফিক বলেন, প্রতিদিন ভোরে হান্নান আমার আগেই কাজে যেত। ঘটনার দিন ১৮ জুলাই ভোর সাড়ে ৬টায় হান্নান কাজে যায়। আমি আগে কাজ শেষ করে বাসায় এসে ঘুমাচ্ছিলাম। সকাল ১০টার দিকে তার রুমমেট রনি ফোন করে জানায়, বাড্ডা থানার সামনের ফুটওভারব্রিজের নিচে হান্নান গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই ভোর সাড়ে ৪টায় তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, হান্নানের নাভির নিচে ডান পাশে গুলি লেগে অপর দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আইসিইউতে নেওয়া হয় এবং কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়।
রফিকের স্ত্রী জান্নাত বলেন, হান্নান খুবই দানশীল ছিলেন। বিয়ের আগ থেকেই তার আয়ের একটি অংশ গরিবদের দান করতেন, যদিও তার মাসিক বেতন ছিল ২০-২৫ হাজার টাকা।
বড় ভাই ইমান হোসেন বলেন, হান্নানের নাভির নিচে গুলি লেগে রক্তক্ষরণ হয়। তাকে ঢাকা মেডিকেলে ৮ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। মৃত্যুর পর সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ চাঁদপুরে আনা হয় এবং বাড়ির পাশের মসজিদের সামনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমি প্রথমে ঢাকায় কাজ নেই এবং পরে ভাইদের একই কাজে যুক্ত করি। হান্নানের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ঘর বানানোর, কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ভাই হত্যার বিচার চেয়ে গত বছরের ২৪ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করি। আদালত ২ সেপ্টেম্বর বাড্ডা থানাকে মামলা রুজু করতে নির্দেশ দেন। মামলায় পুলিশের আইজিপিসহ ৮ কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।
বাবা আমিন মিয়া বলেন, শেষবার ছেলেকে দেখেছি গত কোরবানির ঈদে। সে ঢাকা থেকে গরু কিনে এনেছিল। সবার মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে আদরের সন্তান। আমার অসুস্থতা ও ওষুধের খরচ সব সে দিত।
মা রাশিদা বেগম বলেন, শেষবার ছেলের সঙ্গে কথা হয় ১৭ জুলাই। সে ফোন করে বাড়ির মাটি কাটার কাজের খবর নেয়। সবার খোঁজখবর নেয়। এখন আর আমার খোঁজ নেওয়ার কেউ রইল না। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ছেলে শহীদ হওয়ার পর তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে থাকে। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নানা রোগে আক্রান্ত। সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি। প্রতি মাসে দুজনের ওষুধে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।
হান্নানের স্ত্রী মুক্তা বলেন, ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সর্বশেষ কথা হয়। তখন তিনি বেকারি থেকে বাসায় যাচ্ছিলেন। পরে জা জান্নাত বেগম থেকে জানতে পারি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি জানতেন আমাদের কন্যা সন্তান হবে। তিনি বলেছিলেন মেয়েকে হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়াতে হবে। আমি একা মেয়েকে বড় করতে পারব না। সরকারের সহযোগিতা দরকার। স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
চাচা আব্দুল মতিন বলেন, ভাতিজা হান্নান সামাজিকভাবে সক্রিয় ছিল, ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য ছিল। মৃত্যুর পর মামলার কাজে আমি সহযোগিতা করেছি। হাজীগঞ্জের বিএনপি নেতা প্রকৌশলী মমিনুল হক আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত হান্নানের পরিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রথমে ২০ হাজার টাকা, পরে ২ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, বিএনপি নেতা প্রকৌশলী মমিনুল হকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছে।
আরবি