ঢাকা, রবিবার, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২০ জুলাই ২০২৫, ২৪ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

এখনো শোকে কাতর শহীদ আজাদের পরিবার

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:০৬, জুলাই ২০, ২০২৫
এখনো শোকে কাতর শহীদ আজাদের পরিবার শহীদ আজাদ সরকার (ইনসেটে), ব্যাকগ্রাউন্ডে তার বাড়ি

চাঁদপুর: গেল বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের নিজ এলাকায় থেকে সহযোগিতা করতেন চা দোকানি আজাদ সরকার (৫৯)। ওই সময় একই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নজরে আসেন তিনি।

গত ৪ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্রের হামলার শিকার হন আজাদ।  

গুরুতর আহত হয়ে ওই দিনই চিকিৎসারত অবস্থায় কুমিল্লায় মারা যান তিনি। এরপর থেকে অভিবাবকহীন হয়ে পড়ে তার পরিবার। স্বজনরা তার স্মৃতি নিয়ে শোকে কাতর।

আজাদ সরকার চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার টোরাগর সরকার বাড়িতে ১৯৬৫ সালের ১১ মার্চ জন্ম হয় তার। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে। বাবা আনু মিয়া সরকার ও মা সাহিনা রানী আগেই মারা গেছেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে দুই বোন নুর জাহান বেগম ও পারভিন আক্তার পারুলও মারা গেছেন কয়েক বছর আগে।  

এখন আজাদ সরকারের পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী লাকি বেগম (৫৫) আর চার সন্তান।  

তার বড় ছেলে রাজিব সরকার (৩৮) ও মেজো ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৩৩) রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সেজো ছেলে আহমেদ কবির হিমেল (২৪) এইচএসসিতে ভোকেশনালে পড়ছেন। আর ছোট ছেলে ইরফান আহমেদ সামির (২০) সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, এখন বেকার।

শহীদ আজাদ সরকারের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।

আজাদ সরকার বিয়ে করেছেন একই উপজেলার হাটিলা ইউনিয়নের নোয়া পাড়ায়।  

শহীদ আজাদ সরকারের তৃতীয় ছেলে আহমেদ কবির হিমেল জানান, হিমেলও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। হিমেল নিজে ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি। জেলা সদরে আন্দোলন আগে শুরু হলেও আবু সাঈদের মৃত্যুর পর হাজীগঞ্জে আন্দোলনের মাত্রা বাড়ে। তখনই তার বাবা হিমেলকে সতর্ক থাকতে বলেন এবং আর্থিক সহায়তা করেন।

হিমেল জানান, ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে রাখের ছাত্র-জনতা। ওই সময় তিনি বাড়ির সামনে আন্দোলনকারীদের পানি দিয়ে এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। ওই সময় কাজী বাড়ির মিঠু কাজী ও তুষার কাজীর নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল তাদের বাড়ির সামনে আসে এবং হিমেলকে খোঁজে। সেসময় আজাদ তার দোকানের সামনে ছিলেন। ওই দলটি হিমেলকে না পেয়ে তার বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। আহত অবস্থায় নিজেই ঘরে ফেরেন আজাদ। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রথমে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে কুমিল্লার ট্রমা সেন্টারের আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে ওই রাতেই লাশ এনে টোরাগড় ৭ নম্বর ওয়ার্ড বাচ্চু কমিশনারের বাড়ির সামনে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

হিমেল স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বাবাকে যখন কোপানো হয়, তার কিছুক্ষণ আগে আমার চোখে পুলিশের টিয়ারশেল লেগে যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন ঘরে ফিরে আমি মায়ের কাছে সেবা নিচ্ছিলাম। এ কারণে বাবার ওপর হামলার সময় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। আমি বাবা হত্যা মামলার বাদী। এ মামলায় সঠিক তদন্ত ও জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।

শহীদ আজাদের স্ত্রী লাকি বেগম জানান, আহত অবস্থায় তার স্বামীকে কয়েকজন ধরে প্রথমে ঘরে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে গোপনে বাড়ির পেছন দিয়ে দক্ষিণ পাড়ার একটি ফার্মেসিতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি। অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়ে দুই ঘণ্টা পর অ্যাম্বুলেন্স পেয়ে কুমিল্লায় রওনা হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পরও আজাদ কথা বলেছেন। কুমিল্লা ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসারত অবস্থায়ও জ্ঞান ছিল তার, সন্তানদের খোঁজ খবরও নিচ্ছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি ওই হাসপাতালেই মারা যান।

লাকি বেগম বলেন, শেষ মুহূর্তে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় তার স্বামী-সন্তানদের দেখে রাখতে বলেন। এরপর আর স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি ফিরে এসেছেন লাশ হয়ে।  শহীদ আজাদের দুই ছেলে ও স্ত্রী

স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনি সন্তানদের নিয়ে এখন দিশেহারা। তার স্বামীর রেখে যাওয়া তিন শতাংশ জমির ওপর একটি ভাঙা ঘরে বসবাস করেন লাকি ও তার ছেলেরা। সন্তনাদের নিয়ে বেঁচে থাকতে তাদের একটি বসতঘরও প্রয়োজন।

বড় ছেলে রাজিব সরকার বলেন, বাবা থাকার কারণে আমরা কখনোই কোনো কিছুর অভাব বুঝিনি। পড়ালেখা কম করেছি। যে কারণে রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। বাবাই আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে কাজ পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করতেন। বাবার এমন মৃত্যু আমরা এখন অভিভাবক শূন্য। সরকারের কাছে দাবি, সরকার যেন আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।

মেজো ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমার বাবা খুবই সহজ সরল মানুষ ছিলেন। বাবা হত্যার সঠিক বিচার দাবি করছি।

এদিকে আজাদ সরকারকে হত্যার ঘটনায় ১৫ জনকে আসামি করে হাজীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেছেন তৃতীয় ছেলে আহমেদ কবির হিমেল। এ ঘটনায় হাজীগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কেউ কেউ গ্রেপ্তারের পর জামিনে আছেন। সর্বশেষ প্রধান আসামি মিঠু কাজী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে গেল বছর ৬ সেপ্টেম্বর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আজাদ সরকারের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়।

আজাদ সরকারের সরকারি জুলাই-আগস্ট শহীদ গেজেট নম্বর ৬৭২। মেডিকেল কেস নম্বর: ২২৮০৫। এ পরিবার এখন পর্যন্ত জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রথম বার ২০ হাজার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে ১০ হাজার, ডিসি অফিস থেকে দ্বিতীয় বার দুই লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা, বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে। এছাড়া জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছে এবং বাকি সঞ্চয়পত্রের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেওয়া হয়েছে।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।