ঢাকা, রবিবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

‘অনেকে অনেক কিছু পাইছে, আমার বাচ্চারা হারাইছে বাপডাক’

বদরুল আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:০৮, জুলাই ১৩, ২০২৫
‘অনেকে অনেক কিছু পাইছে, আমার বাচ্চারা হারাইছে বাপডাক’ জুলাই শহীদ মোজাক্কিরের স্ত্রী ও দুই সন্তান

হবিগঞ্জ: ‘আমাদের দেখাইয়্যা অনেকে অনেক কিছু পাইছে, আর আমার বাচ্চারা হারাইছে বাপডাক। আমি স্বামীহারা হইছি।

আমার বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যৎ সবই রইয়া গেছে। ’ — কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোণে জল আসছিল মোজাক্কির মিয়ার স্ত্রী সুজিনা আক্তারের।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় ছাত্রজনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোজাক্কির। তার মৃত্যুর পর জীবন এক কঠিন বাস্তবতায় পড়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তানের।

সুজিনা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট মোজাক্কিরের আঙুলে বিষফোঁড়ার চিকিৎসা হয়। সেদিন তিনি আন্দোলনে যেতে চাইলে আমি বাধা দেই। কিন্তু তাকে ঘরে রাখতে পারলাম না, বের হয়েই গেল। যাওয়া সময় আমাকে বলে গেল, ফিরে এসে দুপুরে ভাত খাব। এরপর ওর ভাতিজারা ফিরলেও সে আর ফিরল না। হঠাৎ আমার মোবাইলফোনে কল এলো, রিসিভ করতেই বলা হলো—‘আপনার স্বামী হাসপাতালে। ’

তিনি বলেন, ভেবেছিলাম, লাঠির আঘাতে আহত হইছে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে দেখি—গুলিবিদ্ধ লাশ।

ভাঙারি ব্যবসায়ী মোজাক্কির ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়েই চলত সংসার—স্ত্রী, দুই ছেলে ও বৃদ্ধা মা। ২০১৮ সালে তাদের বিয়ে হয়। সাত বছরের সংসারে গড়া স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে গেছে।

জুলাই আন্দোলনের পক্ষ থেকে সুজিনার হাতে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দেওয়া হয়। সরকার এবং বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকেও আরও প্রায় ৮ লাখ টাকা সহায়তা আসে। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

‘সঞ্চয়পত্রের টাকায় ছেলেরা স্কুলে যায়। ৮ লাখ টাকার মধ্যে শাশুড়ি ১ লাখ নিলেও আমাদের আর কোনো আয়ের উৎস নাই। টাকাগুলো শেষ হয়ে যাইতেছে, -বলেন তিনি।

মোজাক্কিরের বড় ছেলে মোশাহিদ (৭) মাদরাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে মোশারফ (৫) শিশু শ্রেণিতে পড়ে।  

সুজিনা বলেন, আমি কোনো চাকরি চাই না। শুধু আমার ছেলেদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিক সরকার—যাতে ওরা মানুষ হইতে পারে।

গ্রামীণ পরিবেশে স্বামীহীন জীবন, সন্তানের লালন-পালন ও বৃদ্ধা শাশুড়ির দেখাশোনা— সব মিলিয়ে প্রতিদিন যেন এক কঠিন যুদ্ধ। শুক্রবার (১১ জুলাই) সরেজমিনে নিহতের বাড়িতে গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়।  

মোজাক্কিরের চাচি পারুল বিবি বলেন, আমার দেবরছাওয়াল ভালো ছেলে আছিল। মিছিলে যাইতেছে কইয়া বলছিল, শহীদ হইলে গর্বের ব্যাপার হইব। হইছে ঠিকই, কিন্তু বউমা আর নাতিপুতির জীবনে নামছে ঘোর দুর্দিন।

মা খোশবানু বলেন, পুতলা ঘরা আইয়া ‘মাই মাই’ কইয়া ডাক দিত, মনটা জুড়াইতো। গেছিল, আর আইল না। অহন আর কিছু কইবার নাই।
মোজাক্কিরের মৃত্যুর পর তার বোন হাফিজা বেগম একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে মায়ের দেখভাল করছেন।

৫ আগস্টের ঘটনা
সেদিন সাগরদিঘীর পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল বের হয়। প্রায় ১০ হাজারের বেশি লোক গ্যানিংগঞ্জ হয়ে শহীদ মিনারে জড়ো হয়।
পরে থানার সামনে পুলিশের সঙ্গে উত্তেজনার একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন গুলিতে ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় আটজনের। এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধরা। পরে থানার এক উপ-পরিদর্শককেও (এসআই) পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এসআই সন্তোষ হত্যার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে, আহত ছাত্রের বাবার পক্ষ থেকে ও নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে মোট তিনটি মামলা হয়। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।

নিহতদের মধ্যে যারা ছিলেন— বানিয়াচং উপজেলার ভাঙ্গারপাড়ের ছানু মিয়ার ছেলে হোসাইন মিয়া, জাতুকর্ণপাড়ার আব্দুন নূরের ছেলে আশরাফুল ইসলাম, আব্দুর রউফ মিয়ার ছেলে তোফাজ্জল হোসেন, পাড়াগাঁওয়ের শমসের উল্যার ছেলে মোজাক্কির মিয়া, পূবগড়ের ধলাই মিয়ার ছেলে সাদিকুর রহমান, কামালখানীর মৃত আলী হোসেনের ছেলে শেখ নয়ন হোসেন, সাগর দিঘীর পূর্বপাড়ের মোশাহিদ আখঞ্জীর ছেলে সোহেল আখঞ্জী, চানপুরের মৃত তাহের মিয়ার ছেলে আকিনুর রহমান ও খন্দকার মহল্লার আবুল হোসেনের ছেলে আনাস মিয়া।

এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।