ঢাকা, সোমবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জুন ২০২৫, ১২ জিলহজ ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

রঙিন ইউরোপে কষ্টের প্রবাস জীবন

সাগর আনোয়ার, জার্মানি থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৩২, জুন ৯, ২০২৫
রঙিন ইউরোপে কষ্টের প্রবাস জীবন

স্পেন থেকে ইংল্যান্ড কিংবা ফিনল্যান্ড থেকে ফ্রান্স। ইউরোপের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুউচ্চ আর সুরম্য প্রাসাদোপম দালান, চোখ ধাঁধানো শপিং মল, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুইজারল্যান্ড, আইফেল টাওয়ার কিংবা অপরূপ ভেনিসের জলকেলি।

 

কিন্তু ইউরোপের এ চাকচিক্য কি সবার জন্যই? ইউরোপীয় কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবাই কি এ রূপ-সৌন্দর্যে অবগাহন করতে পারে?

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ও কথা বলে জানা গেছে, খোদ ইউরোপীয়দের অনেকেই বিভিন্ন স্টেশনের ছাউনিতে কিংবা রাস্তার ধারে গৃহহীন জীবন-যাপন করেন। আলো ঝলমলে এ ইউরোপে বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ এখনও দেশে পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কষ্টের জীবন যাপন করছেন। ঈদের দিন ও বন্ধের দিনগুলোতেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে হোটেল কিংবা রেঁস্তোরায়।

ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশ ইতালিতে সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস। সংখ্যাটা প্রায় তিন লাখের মতো। ইতালির রাজধানী রোম, পর্যটন নগরী মিলান কিংবা ভেনিস—এসব শহরের হোটেল, রেঁস্তোরা অথবা মনোহারি দোকান—কোথায় নেই বাঙালির সরব পদচারণা! রাস্তায় বের হলেই দেখা মেলে বাঙালির। এদের মধ্যে কেউ কেউ ইতালিতে ২০ কিংবা ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। যাদের অনেকেই ব্যবসা কিংবা চাকরি করে এখন সফল। কিন্তু রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া, যাদের এখনও বৈধ অবস্থানের অনুমোদন হয়নি, তাদের অবস্থা দুর্বিষহ। খুব কম বেতনে তাদের বাঙালি দোকানে কিংবা ভারতীয় দোকানে কাজ করতে হয়। দিনে ১০/১২ ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যা পান, তা সামান্যই।  

কিন্তু এতকিছুর পরও তাদের চেহারায় থাকে তৃপ্তির হাসি। কিছুদিন পরেই স্বপ্নের কাগজ (বসবাসের আইনি অনুমোদনপত্র) হয়ে যাবে। আর এরপরই তুলনামূলকভাবে ভালো চাকরি করে পরিবারকে আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারবে। এ আশায় তারা বুক বেঁধে আছে। ইউরোপে থাকা প্রবাসীদের একটি বড় অংশের জীবন-জীবিকার সব কিছুই যেন বাংলাদেশে থাকা পরিবারকে কেন্দ্র করে।

ভেনিসের মনোহারি দোকানি মাদারীপুরের রবিউল ইসলাম। ভেনিসের ট্রেন স্টেশনের পাশে নদী ঘেঁষেই তার ছোট দোকান। তিনি জানান, তিনি প্রথমে দুবাই ছিলেন। সেখান থেকে ইরান, ইরান থেকে তুরস্ক, এরপর গ্রিস হয়ে ইতালি এসেছেন। এ দীর্ঘ ভ্রমণে তাকে অমানুষিক পরিশ্রম ও বিপুল টাকা খরচ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে দীর্ঘদিন তার বসবাসের (কাগজ) অনুমোদন ছিল না, এখন তার অনুমোদন হয়েছে। তিনি নিজেই ভেনিসে নিজের ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছেন। তার মা-বাবা, স্ত্রী স্বচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দ্যে আছে আর সন্তান স্কুলে পড়ছে।

বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে কি না জানতে চাইলে রবিউল বলেন, আসলে দুবাই থেকে ইতালি আসার প্রথম ১১ বছর বাংলাদেশে যেতে পারিনি। বিয়ে করেই দুবাই চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ইতালি। প্রথম ইতালিতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কাগজ ছিল না। ভালো কাজ ছিল না। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। তবে মনোবল ছিল। মা-বাবার দোয়া ছিল। ধৈর্য ধরে ছিলাম। পরে কাগজ হয়েছে। দেশে টাকা পাঠিয়ে নিজের বাড়ি করেছি। কিন্তু পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্ট সব সময়ই ছিল। এটা তো আসলে বলে বোঝানো যাবে না। শেষবার যখন দেশে যাই, ছেলের বয়স তখন ১০ বছর হয়ে গেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে কী যে অনুভূতি হয়েছিল তা বোঝাতে পারবো না। তখন মনে হয়েছিল এতো কষ্ট, এতোদিনে স্বার্থক হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখন সামার (গ্রীষ্মকাল) চলছে। পর্যটক বেশি। ঈদের দিন সারাদিনই দোকানেই ছিলাম। এখন সপ্তাহে সাতদিনই দোকান খুলতে হয়। এই যে এতো কষ্ট ভিডিও কলে ছেলেকে দেখলেই সব ব্যথা দূর হয়ে যায়।

পর্তুগালের লিসবনে থাকা টাঙ্গাইলের বাসিন্দা সোহেল রানা জানান, লিবিয়া থেকে তিনবার ‘গেম’ (নৌকা নিয়ে ইতালি যাওয়ার পদ্ধতি) দিয়ে ইতালি এসেছি। প্রায় বিশ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ইতালিতে কয়েকবার ‘কেস’ (রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন) রিজেক্ট হয়েছে। পরে এসেছি পর্তুগাল। কিছুদিন ক্যাম্পেও ছিলাম। প্রতিনিয়ত মা-বাবাকে মনে পড়ে। মাঝে মাঝে খুব একাকিত্ব বোধ করি। মা-বাবাকে ছেড়ে, কাগজপত্রহীন জীবন যে কত কষ্টের তা বোঝাতে পারবো না। টুকটাক যা ইনকাম করি তাই দিয়ে জীবন চলে যায়। বাড়িতে বেশি টাকাও পাঠাতে পারি না। এবার ঈদে কিছু টাকা দেশে পাঠিয়েছি আর আমি সারাদিন কাজ করেছি। মানুষ তো মনে করে ইউরোপ মানেই টাকার পাহাড়। কিন্তু জীবন তো এখানেও অনেক কঠিন। কেউ প্রকাশ করে, কেউ কিছু বলে না। এটাই বাস্তবতা।

শুধু ইতালি বা পর্তুগালের বাঙালিদের বর্ণনাই এমন নয়, ফ্রান্স ও স্পেনের বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলেও এমন তথ্য জানা যায়।

ফ্রান্সের প্যারিসের প্রধান ট্রেন স্টেশনের পাশে অবৈধ সিগারেট ও পানের ডালা নিয়ে মিষ্টি পান বিক্রি করতেও দেখা যায় বাঙালিদের। প্যারিসেও প্রচুর বাঙালির বসবাস। সেখানেও রয়েছে কাগজ (বসবাসের অনুমোদনপত্র) না হওয়ার যন্ত্রণার গল্প।

প্যারিসের ট্রেন স্টেশনের পাশে মোবাইল এক্সেসরিজের দোকানি সিলেটের আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম) জানান, প্যারিসে এখন অনেক বাঙালি। নতুন যারা আসছেন, তাদের বেশিরভাগেরই এখন ফ্রান্সে বৈধ কাগজ হচ্ছে না। ফলে এখান থেকে তারা পর্তুগাল কিংবা স্পেন চলে যান। সেখানে কাগজ হলে পরে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন।

তিনি বাঙালিদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান বর্ণনা করে বলেন, প্যারিস ও ফ্রান্সে অনেক বাঙালি ভালো অবস্থানে আছেন। খুচরা থেকে বড় ব্যবসা ও রেঁস্তোরা ব্যবসা করেও অনেকে সফল। কিন্তু সবার সফলতার গল্প তো আর এক না। এখনও অনেক বাঙালি এখানে অনেক কষ্ট করেন। দিনরাত উবারে খাবার ডেলিভারি করেন। অনেকে কষ্ট করে একটা দোকান দিলেও ব্যবসা ভালো না হওয়ায় দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। অনেকে ১০/১১ ঘণ্টা হাড়ভাঙা কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে।

তবে ইউরোপে শুধু যে শ্রমজীবী হিসেবেই বাঙালিরা কাজ করছেন, এমন নয়। ইতালি থেকে জার্মানি সব জায়গাতেই পড়ালেখা করতে আসা বাঙালিরা এখন অনেক ভালো চাকরিও করছেন। ব্যবসা করেও অনেকে সফল।

ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইমরান আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেকে ইংল্যান্ডের এমপি হয়েছেন। ব্যবসাতেও অনেকে সফল। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও সফলতার অনেক গল্প আছে। আমরা যদি আমাদের দেশের তরুণদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভাষা ও কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ করতে পারি, তাহলে ইউরোপের শ্রমবাজারে তাদের কাজে লাগাতে পারবো। এজন্য দরকার সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগ।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।