গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেড় দশকেরও বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে।
জনরোষে গদি হারানো আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থানের আট মাস পেরোলেও ছন্নছাড়া। তাদের কিছু মন্ত্রী-এমপি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো উন্নত দেশে ভোগবিলাসে কাটালেও দেশে থেকে যাওয়া নেতা-কর্মীদের দিন কাটছে আত্মগোপনে ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে। এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এর মধ্যে অবশ্য বিদেশে নিরাপদে থাকা নেতা ও অ্যাক্টিভিস্টদের উসকানিতে কিছু কর্মী-সমর্থক ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দলটির গণহত্যায় অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর সরকার।
এমন দিশেহারা অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, আওয়ামী লীগের পরিচিত কিছু নেতা-নেত্রীকে সামনে রেখে নতুন আওয়ামী লীগ বা পরিচ্ছন্ন আওয়ামী লীগকে বাজারে আনার পরিকল্পনা চলছে এবং তা বেশ এগিয়েছে।
যদিও এই পরিকল্পনার কথা কয়েক সপ্তাহ আগেই আলোচনায় আসে। জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সদ্যগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টির) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ এ সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্ট দিলে তা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে।
২০ মার্চ দেওয়া সেই পোস্টে হাসনাত বলেন, “আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝতার বিনিময়ে আমরা যেন এ প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদের বলা হয়, এরই মধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ”
‘আমাদের আরও বলা হয়, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে। আমাদের এ প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তাৎক্ষণিক বিরোধিতা করি এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করার কথা জানাই’, যোগ করেন হাসনাত।
আনন্দবাজার পত্রিকায় বুধবার (১৬ এপ্রিল) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের পরিচিত কিছু নেতা-নেত্রীকে সামনে রেখে নব্য আওয়ামী লীগ বা পরিচ্ছন্ন আওয়ামী লীগকে বাজারে আনার একটি পরিকল্পনা বাংলাদেশে বেশ এগিয়েছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব এই প্রয়াসকে ‘প্রতারণা’ ও তাদের ‘দলকে ধ্বংস করার চক্রান্ত’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। ভারতের কূটনীতিকদের একাংশও মনে করেন, হাসিনাকে বাদ দিয়ে নব্য আওয়ামী লীগ গঠিত হলে দিল্লির পক্ষে তা সুখকর হবে না। কারণ এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের যেসব আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীর নাম উঠে আসছে, তাদের ভাবমূর্তি আদৌ পরিচ্ছন্ন নয়, তার ওপরে পাকিস্তান-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে কয়েকজনের।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই কৌশলে আওয়ামী লীগ থাকবে, নেতৃত্বে শেখ হাসিনা থাকবেন না। তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নেতারাও বাদ যাবেন।
প্রতিবেদনটিতে ভারতের এক সাবেক কূটনীতিকের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে দিল্লির কিছু করণীয় নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে ভারতের বন্ধু ও আস্থাভাজন রাজনৈতিক শক্তি। তার নেতৃত্বও পাকিস্তান-বান্ধবদের হাতে চলে গেলে ভারতের পক্ষে তা কম বিপর্যয়কর হবে না। ’
হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টের প্রসঙ্গ টেনে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘হাসনাতের পোস্টের আগেই আমরা এই চক্রান্তের বিষয়টি জানতে পারি। নামগুলিও নতুন নয়। এভাবে তারা দেখাতে চায়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেও অংশ নিতে দেওয়া হয়েছে। তবে সেটা হবে প্রতারণা। মানুষকে এভাবে ভুল বোঝানো যায় না। ’
ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘চক্রান্তকারীরাও জানে, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগ টিকবে না। আদতে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করাই তাদের লক্ষ্য ‘
কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাষ্যে, আপাতত এই ‘রিফাইন্ড’ চক্রান্তই তাদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দাবি, বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, হাসিনার বিরুদ্ধে তোপ দাগলে তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এলাকায় ফিরে নির্বাচনে অংশ নিতেও দেওয়া হবে। অন্যথায় তাদের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার।
এই পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে দলের ওই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, জেলায় জেলায় ভার্চুয়াল মিটিং করছে হাইকমান্ড। সেই মিটিংয়ে শেখ হাসিনা নিজে যুক্ত হচ্ছেন। ঘণ্টা কয়েক ধরে তিনি কর্মীদের কথা শুনছেন। তাদের বলছেন, ‘এদের (অন্তর্বর্তী সরকার) দিন ফুরিয়ে আসছে। আমি যখন বেঁচে রয়েছি, শীঘ্রই ফিরব। কর্মীদের ওপরে হওয়া প্রতিটি নির্যাতনের বিচার করব। ’
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীদের আশার বাণী শোনাতে গিয়ে হাসিনা বলছেন, ‘আমি দেশ ছাড়তে চাইনি। ইস্তফাও দিইনি। আমাকে জোর করে প্লেনে তুলে দেশছাড়া করা হয়েছে। চক্রান্ত করে আমার সরকার ফেলা হয়েছে। এর শেষ দেখে ছাড়ব। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫
এইচএ/