যশোর: যশোরের রাজনীতিতে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে দোলাচল থাকলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
ছয়টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত যশোর জেলা। এর মধ্যে সব থেকে ভিআইপি আসন যশোর-৩। এটি জেলা সদর নিয়ে গঠিত। মূলত জেলার শীর্ষ রাজনীতিকরাই এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। আগামী নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।
দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর যশোরের রাজনীতিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখেছেন সাধারণ মানুষ। রাজনীতি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব স্তরে ফ্যাসিবাদীদের একক দৌরাত্ম্য ছিল। সেখানে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। উল্টো বিএনপি, জামায়াতের নেতাকর্মীদের একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়িয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের আটক করে জেলখানায় পোরা হয়েছে। হত্যা, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী।
পক্ষান্তরে পাতানো ভোটে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতারাই একচেটিয়াভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সংসদ-সব স্তরে নিজেদের ক্ষমতা করায়ত্ত করেছেন। কার্যত, এসব কথিত জনপ্রতিনিধি এবং প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নয়নের নামে সরকারি ও দাতাদের অর্থ হাপিশের প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। লুটপাটে ধ্বংস করা হয়েছে সব উন্নয়ন বরাদ্দ। রাস্তাঘাট করার নামে হরিলুট চালানো হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, যিনি মেয়র তিনিই ঠিকাদার হয়ে সব কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্টের পতনের পর সারা দেশের মতো যশোর জেলাতেও নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানাভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।
ইফতারকেন্দ্রিক প্রচারণা: যশোরে বরাবরই পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইফতারি আয়োজন করতে দেখা যায়। কিন্তু, ফ্যাসিস্ট জমানায় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর যশোর জেলার নেতারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আগে এ দুটি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন দল ইফতার মাহফিলের আয়োজন করলেও ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। এমনও দেখা গেছে, দল দুটির পক্ষ থেকে মুসল্লিরা দাওয়াত পেয়ে আসার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে আয়োজন ভন্ডুল করে দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাসিস্টের পতনের পর এবার পুরোদমে ইফতারির আয়োজন করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। দুই দলের জেলা কমিটি থেকে বিভিন্ন ইউনিট প্রায় প্রতিদিন নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের এসব ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেসব কর্মসূচিতে জেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থেকেছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে ইফতারি ও ঈদ উপহারও বিতরণ করা হয়েছে দল দুটির পক্ষ থেকে। অন্য কোনো সংগঠন এ ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করলেও সেখানে দলের নেতারা উপস্থিত থেকেছেন। কর্মসূচিগুলোতে দলের নীতি, আদর্শ তুলে ধরার পাশাপাশি আগামীতে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে কি কি করা হবে, সে বিয়য়ে বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ইফতার মাহফিল করেছেন গণঅধিকার পরিষদের নেতারাও। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান উপস্থিত ছিলেন একটি অনুষ্ঠানে।
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়: এবার ঈদুল ফিতরের দিন থেকে টানা তৃতীয় দিন পর্যন্ত ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনকি সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। যশোর-৩ (সদর) আসনে তার দলের প্রার্থী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। যশোর শহরের ঘোপে তার বাড়িতে ঈদের দিন থেকেই হাজার হাজার নেতাকর্মীর সমাগম ঘটে। নেতাকর্মীরা জেলার বাইরে থেকেও গাড়ি ভরে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এবং তার মা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নার্গিস বেগমের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। এ তালিকায় ছিলেন যশোরের অন্য পাঁচ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারাও।
একই ভাবে জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও যশোর সদর থেকে বিভিন্ন উপজেলায় ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, করছেন। যশোর-৩ আসনে প্রার্থী হিসেবে দল ঘোষণা করেছে যশোর এমএম কলেজের সাবেক ভিপি ব্যবসায়ী আব্দুল কাদেরের নাম। তিনি নিজে সদর এলাকার কর্মসূচিগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অন্যদিকে জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল বলা চলে আস্তানা গেড়েছেন বাঘারপাড়া-অভয়নগরে। এ দুটি উপজেলা নিয়ে যশোর-৪ আসন গঠিত। অধ্যাপক গোলাম রসুল এ আসনে দলের প্রার্থী। দল সূত্রে জানা গেছে, যশোর-৪ আসনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে যশোর জেলা জামায়াত। তারা মনে করছে, নানা কারণে আগামী নির্বাচনে এ আসটিতে তাদের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে অধ্যাপক গোলাম রসুল প্রায় প্রতিদিন ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করে চলেছেন। এসব কর্মসূচিতে দলের ঘোষিত প্রার্থীরা উপস্থিত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর নীতি ও আদর্শ তুলে ধরেছেন।
কর্মীসভা থেকে শুরু করে কৃষক সমাবেশ: যশোরে এবার বিএনপি নেতারা নিজ নিজ এলাকায় ব্যতিক্রমী কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। বিভিন্ন উপজেলায় রোজার আগে এ ধরনের অনেক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি সমাবেশে হাজার হাজার কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা অংশ নিয়েছেন। এসব সমাবেশ হয়েছে মূলত কোনো ফসলের মাঠ বা মাঠের পাশে। সবাই কৃষক বেশে নানা কৃষি উপকরণ নিয়ে হাজির হয়েছেন সমাবেশগুলোতে। সেখানে বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের ফিরিস্তি তুলে ধরে বিএনপি সরকারের উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলো প্রচার করা হয়।
কৃষক সমাবেশের পাশাপাশি কর্মীসভা, প্রতিনিধি সভারও আয়োজন করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
পিছিয়ে ছিল না জামায়াতে ইসলামীও। দলটির নেতারা দায়িত্বশীল সমাবেশ থেকে শুরু করে কর্মীসভা, সুধী সমাবেশ, জনসমাবেশ, দাওয়াতি সপ্তাহ পালনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তুলে ধরছেন আগামী নির্বাচন এবং ক্ষমতায় গেলে জামায়াতের সরকার পরিচালনার নীতিমালা।
প্রশিক্ষণ: যশোর জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে দল ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির অধিকাংশতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত থেকে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে যেতে এবং দলের ৩১ দফা তুলে ধরতে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ যাতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির পাশে থাকে সেজন্য তাদের সঙ্গে ব্যবহারবিধি এবং মানুষের পাশে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও দলের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে বলে দল সূত্রে জানা গেছে।
নারী সমাবেশ আর বৌ-শাশুড়ি সমাবেশ: জামায়াতে ইসলামীর নারী গ্রুপের কথা সবারই জানা। চরম রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও দলটির নারী সদস্যরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ নারীদের মধ্যে দলীয় কার্যক্রম চালিয়েছেন। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বরং আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ কর্মসূচি এখন বেশ জোরালোভাবেই পরিচালনা করছে দলটি।
এদিকে জামায়াতের নারী সমাবেশের আদলে এবার বিএনপিও নারীদের নিয়ে আলাদা কর্মসূচি পরিচালনা করছে। যার মধ্যে একটি হলো বৌ-শাশুড়ি সমাবেশ। যশোর-৬ (কেশবপুর) সংসদীয় আসন থেকে এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সেখানে প্রতিটি পরিবার থেকে ছেলের বৌ এবং শাশুড়িরা উপস্থিত থেকেছেন। ব্যতিক্রমী এ আয়োজন সাড়া ফেলেছে পুরো জেলায়।
জেলা শহরেও মহিলা দলের উদ্যোগে শীতের মধ্যে নারীদের নিয়ে আলাদা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সেখানে দলের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নার্গিস বেগম, খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ জেলার শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। নারীদের অংশগ্রহণে এ ধরনের আরও কর্মসূচি আগামীতে আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
আরও যা হচ্ছে: আরও নানাভাবে জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। সম্ভাব্য প্রার্থী ও নেতারা এলাকায় এলাকায় গিয়ে রাজনৈতিক সহকর্মী ছাড়াও প্রবীণ মানুষদের খুঁজে বের করছেন। তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কেউ মারা গেলে তার জানাজায় উপস্থিত থাকছেন। শোকাহত পরিবারকে শান্তনা দিচ্ছেন। সাবেক নেতাদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি প্রয়াতদের কবর জিয়ারত করছেন। যোগ দিচ্ছেন খেলাধুলা, মিলাদ, দোয়া, বিয়ে, বৌভাত, সুন্নতে খৎনা, জন্মদিন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে।
সব মিলিয়ে যশোরের রাজনীতিতে এখন নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে।
সহায়তা: বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের খবর পেলে সেখানে ভিকটিম ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরসরি ফোনে কথা বলে তাদের খোঁজখবর দিচ্ছেন দলের তারেক রহমান। দিচ্ছেন আর্থিক সহায়তা। তাদের আইনি সহায়তা দেওয়ারও নির্দেশনা দিচ্ছেন দলের নেতাকর্মীদের। সম্প্রতি পাশের জেলা মাগুরায় একটি শিশু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। শিশুটি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়ে যখন হাসপাতালে ছিল, তখন থেকেই আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবীদের প্যানেল করে দেন তারেক রহমান। ১৩ মার্চ শিশুটির মৃত্যু হয়। পরে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শিশুটির পরিবারের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঈদ উপহার পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০২৫
এসআই