ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৯ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

আকাশের ঠিকানায় খোলা চিঠি

জাহিদ হোসেন শোভন, নাট্যাভিনেতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:১৫, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২
আকাশের ঠিকানায় খোলা চিঠি

আকাশের ঠিকানায় খোলা চিঠি

তারিখ : ১৫-০২-২০১২ (০৩ ফাল্গুন ১৪১৮)

ফরীদি ভাই (অভিনয়-গুরু)


আমার শত সহস্র সালাম গ্রহণ করিবেন। পর সমাচার এই যে, আপনার সংগে কথা বলিবার জন্য মন চাহিতেছে
কিন্তু কিছু উপায় না পাইয়া হৃদয়ের আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করিবার তরে কাগজ-কলমের দ্বারস্থ হইয়াছি।

এই পত্র পাঠ
করিয়া আপনি  কিঞ্চিৎ  হাস্য করিতে  পারেন। কারণ  পদ্ধতিগতভাবে পত্রটি  সাধু ভাষায় ও সনাতন রীতিতে লিখিতে মন চাহিতেছে। কি কারণ তাহা আমার জানা নাই।

আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমাদের বুলু ভাইয়ের নিকট আপনার গত হইবার সংবাদ পাইয়া আমি উদভ্রান্তের মত আপনার গৃহে উপস্থিত হই। তখন আপনার গোছলের প্রক্রিয়া  চলিতেছিল।   অশ্রুসিক্ত ঝাপসা চক্ষে  কয়েক  সহস্র মানুষ দর্শন করিলাম। প্রায় প্রত্যেকের বাক রুদ্ধ, চক্ষু ছলছল। আমার হৃদয়খানি বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছিল। আমার অভিনয়-গুরু, আমার অভিনয়ের আদর্শ আজ আমাদের ফেলিয়া কোন অজানার পথে প্রস্থান করিতেছে। কাঁদিতেছিলাম অনেকদিন পর। সহস্র মানুষের ভিড়েও স্মৃতির পর্দায় ভাসিয়া উঠিতেছিল শেষ কয়েকটা বছরে আপনার অবয়ব। পুরা বাড়িতে আপনি একা চেয়ারে-বসা আর আপনাকে অলস ভঙ্গিতে পাহারা দিতেছে একাকিত্ব। কী ঈদ, কী নববর্ষ একই দৃশ্য।

আপনাকে নিয়া যাওয়া হইয়াছিল বিটিভি, এফডিসি, শিল্পকলা একাডেমীতে। সারারাত ঘুমাইয়াছিলেন বারডেমের হিমঘরে। পরদিন বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে অশ্রুভেজা পুষ্প দিয়া ভালোবাসা জানাইয়াছিল পবিত্র শহীদ মিনারে কয়েক সহস্র অযুত ভক্ত। আপনাকে জানানো হইয়াছিল মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় সম্মান। বিউগলের করুণ সুর আর্তনাদ করিয়া ঘোষণা করিতেছিল যে, বাংলার শ্রেষ্ঠ নট, শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী আমাদের হুমায়ুন ফরীদি একবুক অভিমান লইয়া না-ফেরার-দেশে চলিয়া যাইতেছে।

অভিনয়শিল্পে শ্রেষ্ঠ ছিলেন আপনি। যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, দূরদর্শন (টেলিভিশন) ও বায়োস্কোপ-- কোথায় নাই শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। আপনার জন্ম আমেরিকায় হইলে গ্রেগরি পেক, এন্থনি কুইন, টম হ্যাংকস আর ভারতবর্ষে জন্ম হইলে নাসিরউদ্দীন শাহ্, ওম পুরি, নানাপাটেকার শংকিত হইয়া পড়িত।

লিখিতে বসিয়া আজ অনেক কথা মনে ভাসিতেছে, অনেক স্মৃতি হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করিতেছে। আপনি আমাকে প্রায়ই বলিতেন ‘‘তুমি একটা মূর্খ অভিনেতা। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করিয়াছ কিন্তু সাহিত্য বোঝো না, পড়ালেখা নাই। অভিনেতা হইতে গেলে প্রচুর পড়িতে হয়। ” গুরু আমি হৃদয় দিয়া তাহা অনুধাবন করি।

১লা বৈশাখ, ১ জানুয়ারি তে দুপুরবেলা একসঙ্গে আহার করিব বলিয়া অপেক্ষা করিতেন। সারা দুনিয়ার বিখ্যাত ছায়াছবি আমাকে পাশে বসাইয়া দেখাইতেন আর অভিনয় শিখাইতেন। স্মৃতির হাটে লিখিতে বসিয়া চোখ জলে ঝাপছা হইয়া যাইতেছে, অনেক কথা লিখিবার মন চায় কিন্তু পারিতেছি না, অন্য সময় লিখিব ঠিকানাতো জানি-- আকাশ। স্পর্শ করিতে মন চাহিলে চলিয়া যাইব মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে; যেখানে আপনি চির বিশ্রামে রহিয়াছেন।

আমার সাহিত্যজ্ঞান সীমিত, শব্দভাণ্ডার হতদরিদ্র; তাই এই পত্রখানি লিখন মানসম্মত হয় নাই।   তাই আমাকে ক্ষমা করিবেন। আপনাকে পত্রলিখন ছাড়া এই মুহুর্তে অনুভূতি প্রকাশের অন্য কোনও মাধ্যম আমার জানা নাই। আমি বিশ্বাস করিতেছি না যে আপনি এই বসুন্ধরায় আর নাই। হয়তো নয়ন সম্মুখে নাই; তবে মানসপটে আছেন থাকিবেন চিরদিন।

                                       ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই
                                         নয়নেরও মাঝখানে
                                         নিয়েছো যে ঠাঁই। `

আপনার প্রতি গভীর ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও শত সহস্র কদমবুছি জনাইয়া আজকের মতন পত্রলিখন শেষ করিতেছি।

ইতি

আপনার অতি স্নেহভাজন মূর্খ অভিনেতা
জাহিদ হোসেন শোভন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।