বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মারণাস্ত্র ব্যবহারসংক্রান্ত বিবিসির রিপোর্ট নিশ্চিতকরণ এবং চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আদেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। উপরোক্ত দুটি বিষয় নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এখন এক স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন যে শেখ হাসিনার একক আদেশেই জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে বিএনপিই তাদের রোষানলে পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। এর জন্য আওয়ামী লীগেরও বিচার হওয়া উচিত।
আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার স্বকণ্ঠে প্রদত্ত নির্দেশ বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে সেটি যাচাই করে বিশ্বময় প্রচার করেছে বিবিসি।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা আইসিসিতে পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনার আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। গত বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। সুতরাং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড
সংঘটিত করার অপরাধে বিচার করা কিংবা তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর কোনো বাধা থাকতে পারে না বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করেন।
এতে বিএনপির অভ্যন্তরে একটি মহলের মধ্যে শেখ হাসিনার বিচার কিংবা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তা এখন দ্রুত অপসারিত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত দিন যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তা-ও এখন কেটে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিশ্চিত করেছেন। সম্ভবত এরই ভিত্তিতে বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা আর সাত-আট মাস সরকারে থাকছি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এবং আমি কিছু মৌলিক সংস্কার করতে খুবই সিরিয়াস।
আমরা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে যাব না। যতটুকু সংস্কার শুরু হয়েছে, আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। সরকার মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। ’ নির্বাচন ও সংস্কার প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় বলেছিলেন যে ‘বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মেনে নেব না। ’ কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘মৌলিক সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগেই হতে হবে। ’ এখন বিভিন্ন ঘটনার অগ্রগতি ও বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থানগত দূরত্ব ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
তবে নির্বাচনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইস্যুর অভাব হবে না। কারণ ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক তরুণ নেতা এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করছি। ’ এ ক্ষেত্রে যারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কিংবা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয়ে বিরোধ রয়েছে, তাতে যারা ঐকমত্য পোষণ করবে না, তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়েই নাগরিক পার্টির কোনো বোঝাপড়া হবে না।
এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খবরে অনেকে এখনই কিছুটা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছেন। দেশজুড়ে একটা নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দেড় দশক সময়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি। এখন এক ধরনের প্রশান্তি এবং স্বস্তি তাদের মনে কাজ করতে শুরু করেছে। তবে নির্বাচন নিয়ে আমাদের সব দুশ্চিন্তার অবসান এখনো হয়নি। কয়েক মাস ধরে দেশে সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উঠেছে। দেশের সব গণতান্ত্রিক দল না হলেও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করেছে। এই পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে কোনো নির্বাচনী এলাকায় কোনো দলের বাছাইকৃত প্রার্থী দেওয়া হয় না। ভোটাররা বিভিন্ন দলের দলীয় প্রতীকে ভোট প্রদান করে থাকেন। এতে যে দলীয় প্রতীক দেশব্যাপী সর্বাধিক ভোট লাভ করতে সমর্থ হয়, সে দলই সরকার গঠন করে। বিজয়ী দল নির্বাচন শেষে বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে তাদের দলীয় প্রতিনিধির নাম ঘোষণা করে এবং সরকার গঠন করে থাকে। এতে এক আসনে কোনো দলেরই একাধিক প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে লড়াই কিংবা মারামারির আশঙ্কা থাকে না।
একটি সাধারণ নির্বাচনে যে কয়টি দল অংশগ্রহণ করে থাকে এবং তারা দেশব্যাপী যে পরিমাণ মোট ভোট সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়, সে সংখ্যানুপাতেই বিভিন্ন দলের মধ্যে আসন বণ্টন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট না পেলে একাধিক দল নিয়ে কোয়ালিশন সরকারও গঠিত হতে পারে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই পদ্ধতি চালু থাকলেও আমাদের দেশে এটি এখনো অজানাই রয়ে গেছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতিতে তাদের যোগ্য প্রতিনিধিদের সংসদে পাঠাতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক কম ঝক্কি-ঝামেলায়। এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ আরো কয়েকটি দল বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। দলের বর্ষীয়ান নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনের সঙ্গে দেশের সাধারণ নাগরিকরা এখনো পরিচিত হয়ে ওঠেনি। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে গেলে এখন ঘাটে ঘাটে নানা ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্রের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব কিংবা আধিপত্য বিস্তার ঠেকানোর ব্যাপারে উদগ্রীব দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের জনগণও সে ব্যাপারে এখন অনেক স্পর্শকাতর। দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির বিরুদ্ধে এসব ব্যাপারে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরা ক্রমেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠছে। জানতে চাচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে? বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর ও ভূখণ্ড ব্যবহার, তথাকথিত করিডর কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কী করতে যাচ্ছে বিএনপি? বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী তরুণ প্রজন্ম তাদের জাতীয় স্বার্থ, ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় আগের তুলনায় অনেক সচেতন। ছেলে-ভোলানো রাজনীতি করে আগের মতো আর পার পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তারা বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অতীতের রেকর্ড নিয়ে দিনে দিনে অত্যন্ত সোচ্চার হয়ে উঠছে।
যে দল রাজনীতির ক্ষেত্রে যত বেশি বিদেশনির্ভর কিংবা আধিপত্যবাদের প্রভাবাধীন হতে চেষ্টা করবে, তারা আগামী দিনে ততটাই জনসমর্থন বা ভোট হারাতে থাকবে। দেশি-বিদেশি অপশক্তির দালালি কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে কেউ বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। সে কারণেই আগামী নির্বাচন কিংবা নির্বাচনগুলো হবে অত্যন্ত কঠিন ও সংকটময়। এ ধারণা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক কিংবা ভোটারের।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
এসআই