অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার জাতিকে চমৎকার একটি ডাকসু নির্বাচন উপহার দিল। এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম শঙ্কা ছিল, ছিল উৎকণ্ঠা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ না। সারাদেশে যা ঘটে তার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতেই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণ। ছোটখাট কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন হয়েছে উৎসবমুখর।
বিশেষ করে স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে উৎসবমুখর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এই নির্বাচনের আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। ঐ নির্বাচন ছিল একটি প্রহসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্লজ্জভাবে ছাত্রলীগের পক্ষে কাজ করেছিল। শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ২০১৯-এর নির্বাচনের লক্ষ্য ছিল না। ঐ নির্বাচনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল, তাহলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী রাজত্ব নিরংকুশ করা। ক্ষমতাসীনরা ডাকসু দখলের জন্য সবকিছু করেছে।
এবার ডাকসু নির্বাচনে সরকারের কোনো পছন্দ বা পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচনের আগে নীতিনির্ধারণী এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সুস্পষ্টভাবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের নির্দেশনা দেন। সরকার পক্ষপাতহীন থাকলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা করা যায় তা এবারের নির্বাচনে প্রমাণ হলো। এই নির্বাচন বাংলাদেশকে পথ দেখাবে।
নির্বাচনে কে জিতলো, কে হারালো এটি আমার জন্য মুখ্য বিষয় না। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু হওয়াটাই ছিল জরুরি। এই নির্বাচনে যদি গোলযোগ হতো, নির্বাচন যদি পণ্ড হয়ে যেত, তাহলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় বাড়তো। দেশের জনগণ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়া নিয়ে আতঙ্কিত থাকতেন। এই নির্বাচনকে ঘিরে অশান্তি হলে তার প্রভাব পড়তো গোটা দেশে। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন যারা বানচাল করতে চায়, তাদের জন্য এটা হতো এক মহাসুযোগ। তারা প্রচার করতো, ডাকসু নির্বাচনই যে সরকার সুষ্ঠুভাবে করতে পারে না, তারা একটি জাতীয় নির্বাচন করবে কী করে?
এই নির্বাচনে বড় ধরনের গোলযোগ গোটা দেশকে অশান্ত করে তুলতো। ষড়যন্ত্রকারীরা ওঁতপেতে ছিল। ডাকসু নির্বাচনের পর দেশে জুড়ে সন্ত্রাস এবং নাশকতার পরিকল্পনার কথাও আমরা শুনেছি। নির্বাচনের আগে পলাতক স্বৈরাচারের রাজপথে ঝটিকা মিছিলও আমরা দেখেছি। তাই ডাকসু নির্বাচন এই সরকারের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, এই পরীক্ষায় এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
ডাকসু নির্বাচনের পর এখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডাকসু নির্বাচন তাদের জন্য হবে প্রেরণা। এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।
এই নির্বাচন সরকারের মনোবল বাড়াবে। সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন এই সরকারের সক্ষমতার প্রমাণ।
শান্তিপূর্ণ ডাকসু নির্বাচন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হতাশা কাটাতে সাহায্য করবে। পুলিশের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
সবচেয়ে বড় কথা, এই নির্বাচন জনগণকে আশান্বিত করবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষ নানা কারণে উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। শেষ পর্যন্ত দেশের ভবিষ্যৎ কী? দেশ কোথায় যাচ্ছে—এসব আলোচনা কান পাতলেই শোনা যায়। ডাকসু নির্বাচন, এই উৎকণ্ঠার কিছুটা হলেও অবসান ঘটাবে।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ১৩ মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতি দৃঢ়ভাবে সামাল দিচ্ছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শূন্য থেকে তিনি যাত্রা শুরু করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন করে গড়ে তুলছেন। ড. ইউনূস যখন দায়িত্ব নেন তখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইমেজ ছিল তলানিতে। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশকে দিয়েছেন নতুন পরিচয় এবং মর্যাদা।
লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতি ছিল ক্ষতবিক্ষত। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। অর্থপাচার বন্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়ে তিনি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করেছেন। ডলার সংকট সমাধান করেছেন।
গত ৫ আগস্ট, ‘জুলাই বিপ্লব’-এর প্রথম বর্ষপূর্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার নির্বাচনের ব্যাপারে তার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন হবে ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
ডাকসু নির্বাচনের পর দেশবাসী নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হবেন। কারণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথা দিয়ে কথা রাখেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। এজন্যই তিনি বিশ্ববরেণ্য, অনুকরণীয়।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল: auditekarim@gmail.com