ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৫ ভাদ্র ১৪৩২, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

বিশেষ লেখা

গুজব সন্ত্রাসের শেষ কোথায়?

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩৩, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৫
গুজব সন্ত্রাসের শেষ কোথায়?

দেশজুড়ে মব ও গুজব সন্ত্রাসে মানুষ আজ বিভ্রান্ত, আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। মব সন্ত্রাসের ভয়াবহতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

এসব সন্ত্রাস আমাদের আতঙ্কিত করছে। একের পর এক এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জনমনে সৃষ্টি করেছে নানা প্রশ্ন।

কিন্তু গুজব সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাতাসের মতো। আমরা যেমন বাতাসের মধ্যে থেকে বাতাস অনুভব করতে পারি না, তেমন পুরো বাংলাদেশ যেন একটা গুজবের মধ্যে বসবাস করছে। আমরা কোনটা সত্য, কোনটা গুজব তা বুঝতে পারছি না, জনগণ বিভ্রান্ত। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকার সোচ্চার।

কিন্তু গুজব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকার একেবারে নীরব, যার ফলে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক ব্যাধির মতো। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে গেছে গুজবের সবচেয়ে বড় কারখানা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে যেভাবে পারছে গুজব ছড়াচ্ছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ইদানীং গুজব সন্ত্রাসের প্রধান টার্গেট হয়ে গেছে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আজ গুজব সন্ত্রাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশটিকে গত ১৩ মাসে আগলে রেখেছে। তা না হলে এই ১৩ মাসে দেশের পরিস্থিতি কী হতো, তা চিন্তা করলেও শিউরে উঠতে হয়। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পেছনেও সশস্ত্র বাহিনীর একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। যখন সশস্ত্র বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা রক্তপাত চায় না, তারা জনগণের বুকে গুলি ছুড়বে না, জনগণের আন্দোলনকে সমর্থন জানায়, তখন থেকেই জুলাই বিপ্লবের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।

তারপর দ্রুত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে।
সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৈঠক করেন। তারপর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের পতন এবং একটি নতুন সাংবিধানিক সরকার বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আমরা জুলাই বিপ্লবের পর থেকে লক্ষ করেছি যে কোনো কোনো মহল যেন সেনাবাহিনীকে টার্গেট করেই বিভিন্ন রকম অপপ্রচারে লিপ্ত। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় যে এই সময় সশস্ত্র বাহিনী ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে। তারা এসব অপপ্রচার নিয়ে যেন কোনো রকম বাড়াবাড়ি না হয়, সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করেছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান একাধিকবার এই বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আইএসপিআর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে গুজব যেন সব সীমা পরিসীমা অতিক্রম করেছে। এমন সব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা শুধু স্পর্শকাতরই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সরকারের মতবিরোধের এক আষাঢ়ে গল্প বানানো হয়েছে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সৌজন্য সাক্ষাৎ নিয়ে ফাঁদা হচ্ছে কল্পকাহিনি। এই গল্প নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ঝড় তুলছে, অনেকে নানা রকম বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে। কেন এই ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যাচার, সেটি আমাদের গভীরভাবে বুঝতে হবে। এর পেছনে রয়েছে সুগভীর ষড়যন্ত্র।

এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘যেকোনো মূল্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই, নির্বাচন ঠেকাবে। ’ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সরকার জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ রকম একটি বাস্তবতায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কাজেই এবার শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা অতীতে দেখেছি যখন সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছে, তখন দেশে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা আমরা বলতে পারি। ২০০১ সালেও সশস্ত্র বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল। সেই নির্বাচনও ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সফল ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হয়। এবারও এই নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। কারণ দেশে যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তাতে একটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন নিয়ে জনগণের সংশয় রয়েছে। এ রকম বাস্তবতায় সশস্ত্র বাহিনীর ওপরই মানুষের আশা ভরসা। গত ১৩ মাসে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জনগণের একমাত্র ভরসাস্থল। এটাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য একটি মহল এখন উঠেপড়ে লেগেছে, যারা দেশকে অন্ধকার যুগে নিয়ে যেতে চায়। যারা দেশে একটি বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করতে চায়, তারাই সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে অবিরাম মিথ্যাচারে লিপ্ত।

সেনাপ্রধান গত ১৩ মাসে বহুবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। এটি একটি রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার। সেনাপ্রধান বিদেশ সফর করে এসে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর বিদেশ সফরের ব্রিফিং করে থাকেন। যেহেতু এখনো মাঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে সশস্ত্র বাহিনী; কাজেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কেও দেশের প্রধান নির্বাহীকে ব্রিফ করা সেনাপ্রধানের একটি রুটিন দায়িত্ব। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক নিয়ে এমনভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যাতে সেনাবাহিনীর মতো একটি স্পর্শকাতর বাহিনী সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি, অনৈক্য ইত্যাদি কথা বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনী সম্পর্কে অনাস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি একটি সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠান। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গৌরবের ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী। বাংলাদেশের সদস্যসংখ্যা শান্তি মিশনে সবচেয়ে বেশি। এ রকম বাস্তবতায় সশস্ত্র বাহিনীর ইমেজ নষ্ট করে একটি মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। যারা এই ধরনের অপপ্রচার ও গুজব সন্ত্রাসে লিপ্ত তারা আসলে দেশের শত্রু। তারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। কারণ আমরা জানি যে সত্যের চেয়ে গুজব দ্রুত ছড়ায়। অনেক মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গুজব গোগ্রাসে গ্রহণ করে। বিশ্বাস করা না করা পরের বিষয়, কিন্তু অবিরতভাবে একটি মিথ্যা বললে সেই মিথ্যা একসময় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমরা দেখছি যে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। একটি মাজারের ধ্বংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কঠোর বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। মবের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান সেখানে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। সরকার যেমন মবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তেমনি গুজব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও এখন অবস্থান গ্রহণের সময় এসেছে। যারা দেশে নির্বাচন চায় না, যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, যারা জনগণকে একটা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলতে চায়, তারা এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক উত্তরণের অগ্নিপরীক্ষা। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এই নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনী গত ১৩ মাসে অবিচল থেকেছে। বাহিনীটি দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে যেকোনো অবস্থায় জনগণের জানমালের হেফাজত করার জন্য। সে রকম একটি পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তার শেষ কোথায়? তারা কি বাংলাদেশকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চায়? তারা গুজব ছড়িয়ে কি সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল করতে চায়? কিন্তু একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এ দেশের জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক। এসব গুজব ছড়িয়ে জনমনে হয়তো সাময়িকভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে, কিন্তু বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সংকটে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে বারবার সশস্ত্র বাহিনী ত্রাণকর্তা হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাজেই এসব গুজব, বিভ্রান্তি যতই ছড়ানো হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে থাকবে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে বলেই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক

ই-মেইল : auditekarim@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।