ঢাকা, শনিবার, ২২ ভাদ্র ১৪৩২, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

নির্বাচন না হলে পাঁচ সংকটে পড়বে দেশ

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৩২, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫
নির্বাচন না হলে পাঁচ সংকটে পড়বে দেশ অদিতি করিম

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার সুস্পষ্ট করে বলছেন, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে হবে।

নির্বাচন বানচালের সিদ্ধান্ত হবে জাতির জন্য বিপজ্জনক। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যের মর্মার্থ যাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি, তাঁরা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, বাংলাদেশকে একটা ভয়ংকর অনিশ্চয়তা ও সংকটের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন জ্ঞানদীপ্ত মানুষ। তিনি দেশের কল্যাণেই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। সেই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান খুব স্পষ্ট। এটি কি কেবল কোনো রাজনৈতিক দলকে খুশি করার জন্য, নাকি এর পেছনে দেশের অস্তিত্ব এবং জনগণের স্বার্থ জড়িত রয়েছে?

নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্কের সুরাহার জন্য এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা শুধু কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়, কিংবা নিজের অভিপ্রায় চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। এর সঙ্গে রয়েছে জনগণের ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। আমরা যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে সংস্কার, বিচার এবং জুলাই সনদ ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া হয়, যদি এ রকম একটি পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তাহলে কী হবে?

যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি আমরা ভবিষ্যৎ কল্পনা করি, তাহলে দেখব, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এক ঘোর অন্ধকার অমানিশা অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সব সময় ভবিষ্যতের পথ দেখান।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা উন্মোচন করেন। যদি বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে? আসুন, আমরা একটু যুক্তির নিরিখে বিশ্লেষণ করে দেখি। যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে পাঁচ সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।

প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি, সহিংসতা, ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। নির্বাচন যদি শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে না হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বর্তমান যে বিভেদ, হানাহানি এবং অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা চূড়ান্ত রূপ নেবে।

রাজনৈতিক দলগুলো এখন একে অন্যকে অবিশ্বাস করা শুরু করেছে। তখন এই অবিশ্বাস আরো বড় আকার ধারণ করবে। সেটির প্রকাশ্য সহিংস রূপ আমরা দেখব, যার কিছু প্রকাশ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। যদি নির্বাচন হয়, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করবে। নির্বাচনের পর যাঁরা বিজয়ী হবেন, তাঁরা সব রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি ঐক্যের বাংলাদেশ নির্মাণ করার সুযোগ পাবেন। একটি পরিকল্পিত পরিকল্পনায় দেশকে এগিয়ে নেবেন। আর নির্বাচন না হলে ‘আমরা সবাই রাজা’—এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে সবাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে চাইবে। যে যার মতো করে রাজনৈতিক শক্তি বিস্তারের জন্য সব রকমের পন্থা অবলম্বন করবে। এটি দেশের জন্য একটি অশনিসংকেত। যুক্তির বদলে রাজনীতিতে শক্তির প্রাধান্য বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটবে। যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে না হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। কদিন আগে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বিপ্লবের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতেই পারে। ’

সত্যিই কিন্তু গত ১৩ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেন। পুলিশ বাহিনী এখনো পুনর্গঠিত হয়নি। মব সন্ত্রাসকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, অবৈধ অস্ত্রধারী, দখলদাররা যে যার মতো করে অপকর্ম করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতায় ত্রুটি নেই। কিন্তু যেহেতু তারা একটি অস্থায়ী সরকার, তাদের পক্ষে এই সন্ত্রাসী অস্ত্রবাজদের নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। যদি শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হয়, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। খুন, চাঁদাবাজি, মব সন্ত্রাস বাড়তেই থাকবে। অপরাধীরা জোর করে অন্যের বাড়ি দখল করবে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করবে। একটা ‘আইনশূন্য’ রাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশ দ্রুত ধাবিত হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। নির্বাচন না হলে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, তার সুযোগ নেবে অপরাধীরা। এমন একটি পরিস্থিতি হবে—মানুষের জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে যাবে। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এক আতঙ্কপুরী।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকবে। দেশে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে, বর্তমান সরকার একটি অস্থায়ী সরকার। অস্থায়ী সরকারের ওপর ভর করে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চান না। একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় না বসলে কোনো বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। এটি হলো অর্থনীতির সাধারণ সূত্র। গত এক বছরে প্রায় তিন লাখ মানুষ নতুন করে বেকারত্ব বরণ করেছে। সহস্রাধিক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক খাতে এক ধরনের সংকট বিরাজ করছে। বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিকে নানা রকম হয়রানি করা হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে ব্ল্যাকমেইল করছে। ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি সবাই চুপচাপ বসে আছেন। ক্ষুুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তারা ভয়ংকর সংকটে। অনেকেই তাঁদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন।

বেসরকারি খাতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চলছে রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, একটি দেশ শুধু রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে চলতে পারে না। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোতেও সংকট দৃশ্যমান। এ রকম পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তাহলে অর্থনৈতিক সংকট আরো বাড়বে। বেসরকারি খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তারা আরো নিজেদের গুটিয়ে ফেলবেন। আরো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগের পথ দুরূহ হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশ এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত হবে, যে সংকট থেকে উত্তরণের হয়তো আর পথ থাকবে না।

চতুর্থত, গত বছরের জুলাই বিপ্লবের পর যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিপুলভাবে সমর্থন জানিয়েছিল বাংলাদেশকে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বাধিক দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সমর্থন ও শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন। এটি আমাদের জন্য বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে যদি টালবাহানা হয়, অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তাহলে এই আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকবে না। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সুস্পষ্টভাবে দ্রুত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের কথা বলেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহানুভূতি থাকবে না। ফলে বাংলাদেশ বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা কমে যাবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা বেড়ে যাবে। যেসব দেশ বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবকে সমর্থন করেনি, তারা এই সুযোগ নেবে। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো এবং কূটনৈতিক পরাশক্তিরা নতুন করে পরিকল্পনা করবে। বিশ্বের দরজা বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

পঞ্চমত, জুলাই বিপ্লব ছিল স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ছাত্র-জনতা দীর্ঘ ১৫ বছরের এক স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছিল বুকের রক্ত দিয়ে। এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈষম্যমুক্তি। একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ। আর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রথম ধাপ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ঘোষিত সময়ে যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন না হয়, তাহলে জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ব্যাহত হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে। এরই মধ্যে সাধারণ জনগণ হতাশ হয়ে পড়েছে। গত ১৩ মাসে মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন, আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এখন তুলনা করছে। আর এতে সুযোগ পাচ্ছে ফ্যাসিবাদ। পতিত স্বৈরাচার নানাভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নানাভাবে সংগঠিত হচ্ছে। আর এই পুনর্বাসন সংঘটন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে, যদি শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, বিভক্তি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনাস্থা—সবকিছু মিলিয়ে পতিত ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশে ফিরে আসার নতুন সুযোগ তৈরি করে দেবে। এর ফলে শুধু জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাই নষ্ট হবে না, বাংলাদেশের মানুষের যে মুক্তির পথ, সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর এ কারণেই বাংলাদেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু ভাবলে সেটি হবে আত্মঘাতী এবং সর্বনাশা।

আমরা যদি বাংলাদেশকে ভালোবাসি, বাংলাদেশকে যদি আমরা সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে চাই, বাংলাদেশকে যদি আমরা নতুন বাংলাদেশ হিসেবে পুনর্গঠন করতে চাই, তাহলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন না হলে বাংলাদেশ এক দীর্ঘমেয়াদি অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করবে, যেখান থেকে বের হয়ে আসার ক্ষমতা হয়তো কারো থাকবে না।

লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

ই-মেইল : auditekarim@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।