আজকের লেখাটি যাদের নিয়ে তারা হলেন সাংবাদিক। সংবাদের পেছনে থাকেন তারা।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা ও হত্যার ঘটনায় জেগে উঠছে একটাই স্লোগান—‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়’। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই তা প্রতিফলিত করছে?
সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়—এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং একটি মানবিক সত্য ও নৈতিক দাবি। সংবাদ সংগ্রহ, অনুসন্ধান ও প্রকাশ মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকরা শুধু সংবাদ পরিবেশক নন; তাঁরা রাষ্ট্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করেন, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেন এবং সত্যের আলো ছড়িয়ে দেন।
তবে বাস্তবতা আজও ভিন্ন। পৃথিবীর বহু দেশে সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে হয়রানি করা হয়। কখনো অভিযোগ আনা হয় ‘ভুল তথ্য ছড়ানো’, কখনো ‘জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করা’ বা ‘উসকানি দেওয়ার’ মতো অস্পষ্ট অপরাধে। আবার কোথাও সাংবাদিকদের ওপর চালানো হয় নজরদারি, সেন্সরশিপ ও ভীতি প্রদর্শন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের গ্রেপ্তার, কারাবন্দি বা হত্যা পর্যন্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতাকে অপরাধের আসনে বসানো হয়, যা শুধু সংবাদকর্মীদের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য বিপজ্জনক।
এমনকি যেসব দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত, সেখানেও সাংবাদিকদের নানা রকম চাপ ও আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। মানহানির মামলা, রাজনৈতিক হুমকি কিংবা আর্থিকভাবে চেপে ধরার মতো কৌশল ব্যবহার করে তাঁদের নীরব করার চেষ্টা চলে। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা আজ বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই ‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়’ স্লোগানটির জন্ম। এটি বর্তমান অবস্থা নয়, বরং একটি দাবি—একটি ন্যায্য ও মানবিক দাবি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়: সাংবাদিকতা কখনো অপরাধ হতে পারে না, সত্য বলা কখনো অপরাধ হতে পারে না।
২০১৪ সালে মিশরে জেনারেল সিসির সরকার যখন আল-জাজিরার তিনজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, তখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল এই স্লোগান। ‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়’ তখন শুধু তাদের মুক্তির দাবি হয়ে ওঠেনি, বরং বিশ্ব সাংবাদিক সমাজের এক মানবাধিকার মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
আজকের পৃথিবীতে যেখানে ভুয়া তথ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে, আর প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন দুর্বল হয়ে যায়, সেখানে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি। সত্য তুলে ধরতে না পারলে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও সাংবাদিকরা মামলা, হুমকি কিংবা জনসমক্ষে বৈরী আচরণের শিকার হচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা মানে সমাজের সত্যকে রুদ্ধ করা, যা শেষ পর্যন্ত জনগণের অধিকারকে কেড়ে নেয়।
সুতরাং ‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়’—এটি কেবল একটি স্লোগান নয়। এটি একটি মানবিক ঘোষণা, গণতন্ত্রের বেঁচে থাকার শর্ত এবং বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের দাবিকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার। যে পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে চাই, সেখানে সাংবাদিকরা সত্য বলার জন্য কখনো অপরাধী হবেন না; বরং তাঁরা সম্মান ও সুরক্ষা পাবেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ চিত্রে যুদ্ধের নির্মমতার শিকার গাজায় প্রাণ দিচ্ছেন সাংবাদিকরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা সংঘাতে দুই শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
২০২৪ সাল ছিল সাংবাদিক হত্যার দিক থেকে ইতিহাসের ভয়াবহতম বছর—১২৪ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী নিহত। এর মধ্যে আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শারিফের হত্যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার সাত বছর পূর্ণ হতে চললো। সৌদি রাজতন্ত্রের এই সমালোচক ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়ে খুন হয়েছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার আজো হয়নি।
আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শারিফ গাজায় আল-শেফা হাসপাতালের কাছে বিমান হামলায় নিহত হন। ‘ইসরায়েল সাক্ষীদের মুছে ফেলছে’, দ্য গার্ডিয়ান তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছিল গাজায় আজ সাংবাদিক হওয়াই মৃত্যুর শামিল।
বাংলাদেশে গত এক বছরে ছয় শতাধিক সাংবাদিক মামলা, হুমকি ও বহু ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বহু সাংবাদিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, পাসপোর্ট বাতিল এমনকি শারীরিক হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’, তার নিখোঁজ হওয়া খবর ও আত্মহত্যা এবং মরদেহ উদ্ধার— এসব কিছু সবার চোখের সামনে তুলে ধরছে সাংবাদিকদের বঞ্চনা ও নিপীড়নের এক হৃদয়বিদারক সত্য। নদীতে ভেসে থাকা বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ আসলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার লাশ হয়ে ভেসে থাকার খুব নান্দনিকতা সম্পন্ন কোনো সিনেমার দৃশ্যের মতো হয়ে ভেসে ওঠা এক নির্মম সত্য।
নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘের কাছে রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে তিন কাঠা জমির দলিল হস্তান্তর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এই মহান উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে সাগর-রুনির আইনি বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। হবে না!
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সাংবাদিকরা সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আইনি জটিলতা ও আর্থিক চাপে প্রতিদিনই সংকুচিত হচ্ছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর ২০২৫ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স জানাচ্ছে, প্রেস স্বাধীনতা আজ বিশ্বব্যাপী ‘কঠিন পরিস্থিতিতে’। বিজ্ঞাপন নির্ভরতা, মালিকানায় একচেটিয়া প্রভাব, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আধিপত্য—এসবের কারণে সাংবাদিকরা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তার ওপর ভুয়া খবর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার সত্যের লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে।
কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের চিত্র—১২৪ সাংবাদিক নিহত (২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে), ৭ সাংবাদিক নিহত (২০২৫ সালে গাজায় এক হামলায়), ছয় শতাধিক সাংবাদিককে হয়রানি (বাংলাদেশে ২০২৪-২০২৫ সালে)।
আজ বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা একটাই দাবি তুলছেন—নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য বেতন ও আর্থিক স্থায়িত্ব, মিথ্যা মামলা ও রাজনৈতিক প্রতিশোধ থেকে মুক্তি, সেন্সরশিপ ও নজরদারির অবসান, সত্য প্রকাশের অবাধ অধিকার। আল-জাজিরার নিহত সাংবাদিক আনাস আল-শারিফের এক সহকর্মী বলেন, “আমরা চাই শুধু সত্যটা দেখাতে। সত্য যদি অপরাধ হয়, তবে মানবতাই অপরাধ। ”
সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়—এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি মানবতার ঘোষণা। সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ করা মানে জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া। আজকের লেখাটি লিখতে গিয়ে অনুভব হচ্ছে, এই মহান পেশা আজ বহু কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবাদিকতা পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে! অথচ এর চেয়ে সাহসী, মানবাধিকারবোধ সম্পন্ন সম্মানজনক পেশা আর একটারও ঊদাহরণ দেওয়া যাবে না।
অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাংবাদিক হেনরি আনাতোল গ্রুনওয়াল্ডের অমর বাণী—“সাংবাদিকতা কখনোই নীরব থাকতে পারে না: কথা বলতে হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে বলতে হবে। ”
মাহবুব আহমেদ: লেখক, উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী
এমজেএফ