আমাদের দেশে ক্ষমতার হস্তান্তর বহুবার ও নানাভাবে ঘটেছে, কিন্তু ক্ষমতার প্রকৃত রূপান্তর এখনো ঘটেনি। ব্রিটিশ আসার আগে রাজা-বাদশাহদের একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
রাজ্য তখন রাষ্ট্রে পরিণত হলো এবং ওই রাষ্ট্র পুরো ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে সমাজেও একটা পরিবর্তন আনল। বাংলার দিকে তাকালে আমরা দেখব, এখানে শিল্প ও পুঁজির এক ধরনের বিকাশ ঘটেছিল; বাণিজ্য করার নাম করে ইংরেজরা এসে বিকাশের সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে কৃষককে জমিদারের এবং জমিদারকে রাষ্ট্রের প্রজায় পরিণত করল। একদিকে স্থানীয় শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ায় এবং অন্যদিকে ভূমিতে কৃষকের অধিকার হারিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কম্কানির আনুকূল্যে ও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটল, যেটি ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে কিছুটা ক্ষমতা পেল এবং ইংরেজ শাসনকে স্থায়িত্ব দানের কাজে সহযোগিতা করল। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের একটা বড় দুর্বলতা ছিল, সেটা হলো রাজনৈতিকভাবে ধর্মের ব্যবহার। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন হলো এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদ বিকশিত হতে থাকল।
এতে সুবিধা হলো ব্রিটিশ শাসকের। কেননা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ধর্মীয় সাম্ক্রদায়িকতার কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিক্ষোভ সাম্ক্রদায়িকতার গলিপথে প্রবেশ করে দাঙ্গার রূপ নিল এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বাংলায় যে একটা প্রায় বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সাম্ক্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হলো এবং পরিণতিতে দেশভাগ ঘটল।
ইংরেজ শাসক যা করল তা হলো, তাদেরই অনুগতদের হাতে দুই রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা দিয়ে এ ধারণার সৃষ্টি করল যে তারা স্বাধীনতা দিচ্ছে। সাতচল্লিশের দেশভাগে দুটি নতুন রাষ্ট্র তৈরি হলো ঠিকই, কিন্তু সেটি দাঁড়াল ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতায়।
রাষ্ট্র রয়ে গেল আগের মতোই আমলাতান্ত্রিক এবং তার অভ্যন্তরে অর্থনীতি থেকে গেল পুঁজিবাদী। সাতচল্লিশের পরপরই পূর্ববঙ্গে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে। এই জাতীয়তাবাদ আগের মতো ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক বটে এবং সে কারণে ইহজাগতিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হিসেবে, কিন্তু একাত্তরে এসে তা স্বাধীনতার দাবিতে বিকশিত হলো। একাত্তর সালেই আমরা পূর্ববঙ্গবাসী প্রথম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলাম। সে যুদ্ধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি এ কারণে যে কেবল স্বায়ত্তশাসন কিংবা নতুন রাষ্ট্র নয়, অস্কষ্টভাবে হলেও আকাঙ্ক্ষাটা ছিল মুক্তির। সেই মুক্তি অর্জন ব্রিটিশের রেখে যাওয়া পুরনো সমাজব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। স্বপ্নটা ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজের, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের কোনো বৈষম্য থাকবে না এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে, কিন্তু সে লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে পারিনি এবং পারিনি বলে আজ চারদিকে এত হতাশা, সংঘাত ও সংকট।
একাত্তরের যুদ্ধের আগে উনসত্তরে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেখানেও আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লবের।
কিন্তু সামাজিক ক্ষমতার বৈপ্লবিক রূপান্তর ভিন্ন মুক্তি নেইবিপ্লবকে সম্ভব করার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি দেশে ছিল না। অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি ছিলেন বামপন্থীরা, যাঁরা সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন বিভক্ত এবং অসংগঠিত। তাঁদের শক্তি ছিল, কিন্তু সে শক্তি সংগঠিত হতে পারেনি। কেননা সে সময়ে মূল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটা ছিল পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালির; সেই দ্বন্দ্বের সমাধান না করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। বামপন্থীরা এই সত্যকে নিজেদের কর্মসূচির মধ্যে ধারণ করতে পারেননি। পাঞ্জাবি রাষ্ট্রশক্তি এবং বাঙালি জনগণ—এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রটাতে জাতীয়তাবাদীরা যেভাবে আন্দোলন পরিচালনা করলেন, বামপন্থীরা সেভাবে এগিয়ে আসতে পারলেন না। ফলে সাতচল্লিশ সালের পর থেকেই সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্বাধীনতার আন্দোলন তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত হলো না। নেতৃত্ব চলে গেল জাতীয়তাবাদীদের হাতে।
নামে স্বাধীন হলেও এই শাসক শ্রেণি কিন্তু আগের চেয়েও পরাধীন। আগের পরাধীনতা ছিল প্রত্যক্ষ ও গ্লানিকর, কিন্তু বর্তমানের পরাধীনতা অপ্রত্যক্ষ এবং ‘সম্মানজনক’। এই শাসক শ্রেণি যে কতটা পরাধীন তার প্রমাণ পাওয়া যায় কেবল যে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তা নয়, দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বিশ্বপ্রভুদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মান্য করার মধ্যেও। এতে তারা অসম্মানের কিছু দেখে না, বরং বিদেশিরা কতটা ঝুঁকেছে তার মধ্য দিয়েই তারা নিজেদের রাজনৈতিক চরিতার্থতা নিরূপণ করছে।
এই যে কখনো সরাসরি সামরিক শাসন, কখনো সাংবিধানিক-অসাংবিধানিক স্বৈরশাসন আমাদের দেশে এসেছে এবং আছে, তার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটছে বটে, কিন্তু জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন, তা মোটেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। উল্টো দেখা যাচ্ছে যে এই শাসক শ্রেণি যে নামেই আসুক বা যে সরকারই গঠন করুক, তাদের মূল কাজ লুণ্ঠন ও দেশের সম্কদ বিদেশে পাচার করা এবং দেশের ভূমি, বন্দর সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তুলে দেওয়া। ক্ষমতা-বুভুুক্ষু এবং দেশপ্রেমবিবর্জিত এমন শাসক আমাদের ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি।
জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি যে বাস্তব রূপ গ্রহণ করল না, তার কারণ হলো তাদের পক্ষের যে শক্তি, সেটি এখনো, এতসব ঘটনা ও সংগ্রামের পরও সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। আর এ কারণেই দেশপ্রেমবিবর্জিত শাসকের দৌরাত্ম্য অক্ষুণ্ন রেখেছে এবং ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে। অন্যদিকে জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। দেশ এখন ইসলামী জঙ্গিবাদেরও লালনভূমি বটে। মানুষ বিক্ষুব্ধ; আর নিয়ম এই যে বিক্ষোভ কোনো না কোনো দিক দিয়ে প্রকাশিত হবেই। বিক্ষোভ যদি দেশপ্রেমীদের নেতৃত্বে এগোত, তাহলে আমরা সমাজ বিপ্লবের অভিমুখে অগ্রসর হতে পারতাম। শাসক শ্রেণির নির্যাতন ও তাদের করতলগত গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রের বাহিনী ও মব ভায়োলেন্সের কবলে দেশবাসী নিরন্তর পীড়িত হচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সর্বত্রে দৃশ্যমান; যেমন সরকারে, তেমনি রাজনীতিতে প্রকাশ্য দৌরাত্ম্যপনার ফলে ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গি তৎপরতার লক্ষণ স্কষ্ট। এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর নানা দেশে আছে, আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে; যেটি অনভিপ্রেত ও হতাশাজনক বটে।
এককথায় বলা যায়, শাসকদের স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করেছে। কেননা তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। কিন্তু জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন, তার বাস্তবায়ন তাঁদের কাছে প্রত্যাশা করা গাবগাছ থেকে আমের আশা করার শামিল। স্কষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মুক্তির আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। প্রশ্ন হলো, এই আন্দোলন কারা পরিচালনা করবেন? করবেন তাঁরাই, যাঁরা একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক। কেবল দেশপ্রেমিক হলেই চলবে না, কেননা বর্তমান শাসকরাও নিজেদের দেশপ্রেমিক বলে থাকেন। তাই গণতান্ত্রিকও হতে হবে। বিশ্বপুঁজিবাদের অবরোধের মধ্যে গণতন্ত্রের অঙ্গীকার দুটি—এক. সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়া; দুই. সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করা। এই দুটি গুণ যাঁদের মধ্যে নেই, তাঁরা কিছুতেই গণতান্ত্রিক হতে পারেন না।
দেশপ্রেমের অর্থটাও পরিষ্কার। সেটা হলো দেশের মানুষকে ভালোবাসা। দেশ বলতে ভূমি বোঝায়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি বোঝায় দেশের মানুষ। আমাদের শাসকরা ভূমিতে আগ্রহী; মাতৃভূমি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তুলে দিতে দ্বিধা নেই। কিন্তু জনগণের প্রতি বিরূপ, যে জন্য তাঁদের মধ্যে দেখি সাম্রাজ্যবাদের তোষণও। কিন্তু জনগণের দুর্দশামোচনে কোনো আগ্রহ দেখি না, বরং জনগণের তাঁরা চিহ্নিত শত্রু। হানাদার পাঞ্জাবিরাও কিন্তু ‘দেশপ্রেমিক’ ছিল; তারা পূর্ব বাংলার ভূমিকে দখলে রাখতে চেয়েছিল মানুষকে মেরে ফেলে।
ক্ষমতার হস্তান্তর বারবার ঘটছে, আরো ঘটবে, কিন্তু ক্ষমতার বৈপ্লবিক রূপান্তর না ঘটলে যে আমাদের মুক্তি নেই, তা অতীতের ইতিহাস প্রমাণ করছে, ভবিষ্যতের ইতিহাসও করবে, যদি না সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসীরা এগিয়ে না আসেন এবং নিজেদের সংগঠিত করে রাষ্ট্র ও সমাজে মৌলিক পরিবর্তন না আনেন। মৌলিক পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং সব ক্ষেত্রে যথার্থ জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। সেটা না ঘটলে কী ঘটবে, তা তো আমরা প্রতিক্ষণই দেখতে পারছি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়