ঢাকা, বুধবার, ১১ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জুন ২০২৫, ২৮ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

দেশজুড়ে অশান্তি, সান্ত্বনা শুধু ‘বিবৃতি’

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৬, জুন ২৫, ২০২৫
দেশজুড়ে অশান্তি, সান্ত্বনা শুধু ‘বিবৃতি’ অদিতি করিম

দেশের এই স্থবির অবস্থা এবং সরকারের প্রতিক্রিয়াহীন মনোভাব দেশকে আরো সংকটের গভীরে নিয়ে যেতে পারে। আর সে জন্যই প্রয়োজন লন্ডনের যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী একটি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করা

দেশজুড়ে কেমন যেন একটা অস্থিরতা ও অশান্তি চলছে।

কোথাও শান্তি নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা তাঁদের আবাসিক হলের দাবিতে আন্দোলন করছেন।

সেই আন্দোলনে কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতি দিয়েই দায় এড়িয়েছে। বেশ কিছু দিন ধরে সচিবালয়ে আন্দোলন চলছে। উপদেষ্টারা আন্দোলন থামাতে কয়েক দিন পর পর বিবৃতি দিচ্ছেন। বড় ধরনের আন্দোলনের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে এনবিআরে।

সেখানেও সরকার দায় এড়িয়েছে শুধু একটি বিবৃতি দিয়ে। যেখানেই আন্দোলন, সেখানেই বিবৃতি। চারপাশে যা কিছু ঘটছে, সবকিছু সরকার যেন দেখছে, শুনছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। শুধু বিবৃতি দিচ্ছে।

অনেকে এই সরকারের নাম দিয়েছেন ‘বিবৃতি সরকার’।
সম্প্রতি বাজেট নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘এই সরকার কুম্ভকর্ণ সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘সরকার শুনছে, দেখছে; কিন্তু কোনো কাজ করছে না। ’ এটি শুধু হোসেন জিল্লুর রহমানেরই মতামত নয়, গোটা দেশের মানুষের মতামত।

প্রশ্ন উঠেছে, বিবৃতি দেওয়াই কি সরকারের একমাত্র কাজ? সম্প্রতি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নুরুল হুদাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেই মব ভায়োলেন্স নিয়ে হুলুস্থুল হলো। প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্য সফরে লন্ডনে একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার এ ধরনের মব ভায়োলেন্স প্রতিহত করার জন্য সর্বত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের মব সন্ত্রাস কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে বলেও তিনি জানালেন। খুঁজে দেখলাম, গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত শুধু মব সন্ত্রাস নিয়ে সরকার ১৬টি বিবৃতি দিয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মব সন্ত্রাসীরাও সদর্পে বিবৃতি দিয়ে বলছে, এসব তারা করবেই। নুরুল হুদার ঘটনার পরদিন সরকার একটি বিবৃতি দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এবং ভিডিও চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ঘণ্টাব্যাপী নুরুল হুদার ওপর মব সন্ত্রাস হয়েছে। নুরুল হুদা যদি ঘৃণ্যতম অপরাধীও হন, তাঁর শাস্তি দেবে দেশের আদালত, প্রচলিত আইন। কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরবে, চড়-থাপ্পড় মারবে, গালে জুতা মারবে, জুতার মালা পরাবে—এটা কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। সব মহল এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে, উদ্বেগ জানিয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছে সমাধান আছে একটাই, সেটি হলো বিবৃতি।

এই ঘটনার পর সরকারের বিবৃতিটিও দেখার মতো। সরকার বলেছে, ‘এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে ভূমিকা ছিল, তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে কি না সেটি সরকার দেখবে এবং যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। ’ এরই মধ্যে গত ১০ মাসে পাঁচ শর বেশি পুলিশ নিগৃহীত হয়েছে। মব সন্ত্রাসীরা কথায় কথায় পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরিভাবে ভেঙে গেছে। এখন পুলিশ বাহিনীর আর সেই সক্ষমতা নেই—একটি মব সন্ত্রাস থামানোর জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ এখন মবরাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী।
শুধু নুরুল হুদার বিষয় নয়। দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় মব সন্ত্রাস চলছে। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো কর্মকৌশল নেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছেন। কিন্তু মব সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। শুধু মব সন্ত্রাস কেন, কোথাও কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের অ্যাকশন নেই। প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্য সফরে গেলেন। যুক্তরাজ্য সফরের সময় তিনি ১৩ জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করলেন। ওই বৈঠকের মধ্য দিয়েও একটা যৌথ বিবৃতি এলো। কিন্তু সেই বিবৃতির এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকারিতা নেই। ওই বিবৃতি পুরো জাতিকে আশ্বস্ত করেছিল। পুরো জাতি ভেবেছিল, এখন দেশ নির্বাচনের পথে হাঁটবে। অশান্তি, হানাহানি, আন্দোলন, অবরোধ ইত্যাদি থেকে মানুষ মুক্ত হবে। দেশজুড়ে শুরু হবে একটি নির্বাচনী উৎসব।

সত্যি বলতে কি, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকের পর দেশজুড়ে একটা স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্বস্তির আকাশ শঙ্কার কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পরও পদক্ষেপ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা পাননি। সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতি বাস্তবে প্রতিপালন করবে কে? সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে চলছে ম্যারাথন আলোচনা। এভাবে আলোচনা করে বছরের পর বছর সময় পার করে দেওয়া যায়। কিন্তু সমাধান কী? জনগণেরই বা কী লাভ তাতে? সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত থাকুক, কারো কোনো আপত্তি নেই। পাশাপাশি নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করতে বাধা কোথায়? বিশেষ করে এখন সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। যখন প্রধান উপদেষ্টা বা সরকার নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি সম্ভাব্য সময় বলবে, তখন নির্বাচন কমিশনকে অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রথমত, তাকে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৭৫টির মতো বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধগুলো নিষ্পত্তি করা সময়সাপেক্ষ। হালনাগাদ ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে। ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। যাঁরা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নন, তাঁদের সেখানে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। সীমানা নির্ধারণের পর নির্বাচন কমিশনকে ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করতে হবে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের বাছাইপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে হবে। এই কাজগুলো শেষ না করে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচন বিশ্লেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, এই কাজগুলো শেষ করতে অন্তত সাত থেকে আট মাস সময় লাগবে। অর্থাৎ এখনই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ।
প্রতিদিন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হচ্ছে। সেখান থেকেও আসছে বিবৃতি। দেশে এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে বিবৃতি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিচ্ছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিচ্ছে, এনবিআর বিবৃতি দিচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা বিবৃতি দিচ্ছেন। যৌথ বিবৃতিসহ নানা ধরনের বিবৃতি আসছে। কিন্তু এই বিবৃতিগুলো বাস্তবায়ন করবে কারা, কিভাবে? সেটি এখন এক বড় প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই।

দেশের এই স্থবির অবস্থা এবং সরকারের প্রতিক্রিয়াহীন মনোভাব দেশকে আরো সংকটের গভীরে নিয়ে যেতে পারে। আর সে জন্যই প্রয়োজন লন্ডনের যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী একটি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করা। কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়? সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। জুলাই সনদ, গণহত্যার বিচার—এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। এর সঙ্গে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার বিরোধ কোথায়? যদি ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করে জুলাই মাসে সনদ চূড়ান্ত করে এবং জুলাই সনদে যদি সবাই স্বাক্ষর করে, সেই সময়ের মধ্যে যদি নির্বাচন কমিশন তার অনেকগুলো কাজ এগিয়ে নেয়, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? তাহলে কি জুলাই সনদের আগ পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে? একটির সঙ্গে আরেকটিকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন?

এই সরকারের বেশির ভাগ সদস্যই এসেছেন বস্তুত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রধান কাজ হলো যেকোনো বিষয়ে মতামত দেওয়া। তারা কাজ করে কম, কথা বলে বেশি। প্রকৃত উন্নয়নের চেয়ে সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপেই সময় ব্যয় করে বেশির ভাগ এনজিও। এখন সরকারও যেন চলছে এনজিও টাইপে।

মনে রাখতে হবে, এই সরকার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার। জনগণের বিপুল সমর্থন রয়েছে এই সরকারের প্রতি। কাজেই এই সরকারকে কাজ দেখাতে হবে। শুধু সব বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিটি সমস্যার গভীরে যেতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হবে। এনবিআরের যে শাটডাউন কর্মসূচি, সেই কর্মসূচির কারণ কী, তার অনুসন্ধান করতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলে একটি যৌক্তিক সমাধানে যেতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমস্যা কত দিন ঝুলিয়ে রাখা হবে? সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিটি করপোরেশনের সমস্যার একটি ইতিবাচক ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান করতে হবে। সমাধান করতে হবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের আবাসনের।

এই সরকারের এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে, শুধু যমুনা ঘেরাও করে ব্যাপক আন্দোলন করলে সরকার সেই দাবি মেনে নেয়। তার আগ পর্যন্ত সরকার চুপচাপ বসে দেখে। এটি একটি সরকারের কাজ হতে পারে না। তাই অবিলম্বে প্রয়োজন সরকারের দুটি কাজ করা। প্রথমত, লন্ডনের বিবৃতির আলোকে একটি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা; দ্বিতীয়ত, যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে দ্রুত কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মানুষ আর নিতে পারছে না। বিবৃতি এখন জনগণের কাছে এক বিরক্তি।
 
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ই-মেইল : auditekarim@gmail.com

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।