রাজনীতিবিদরা কিছু কথা বলেন, কিছু কথা বলতে চান না। সময়ের অপেক্ষায় থাকেন।
কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে ১০ দিনের সরকারি ছুটি ইসলামি দেশগুলোর ইতিহাসে সম্ভবত বিরল। দেশের মানুষ যাতে নিরাপদে-নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছতে পারে, সবার সঙ্গে ঈদ করতে পারে সেজন্য এমন সিদ্ধান্ত সত্যি প্রশংসনীয়। এ দীর্ঘ ছুটিতে কারখানার উৎপাদন কিছুটা বিঘ্নিত হলেও ঢাকা শহরের অবরোধ কর্মসূচি আপাতত বন্ধ হলো। এ সময়ের মধ্যে যমুনার সামনে কেউ যাবে না অথবা কেউ শাহবাগ অবরোধ করবে না। আপাতত কিছুদিনের জন্য অবরোধমুক্ত হলো নগরবাসী। রাজনীতিবিদরা কিছু কথা বলেন, কিছু কথা বলতে চান না। সময়ের অপেক্ষায় থাকেনতবে পরবর্তী সময়ে কোনো অজুহাতে আর যেন কেউ রাস্তা অবরোধ করতে না পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এত জনদুর্ভোগ নগরবাসী আর সহ্য করতে পারছে না। রাজধানীবাসী নানান সমস্যা থেকে আপাতত মুক্ত থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অশান্তিতে আছে দেশবাসী। রাজনৈতিক দলগুলো নানান জটিল সময় পার করছে। কারও মধ্যে কোনো স্থিরতা নেই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সংস্কার কীভাবে হবে, জুলাই সনদে কী থাকবে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না, সরকার ডিসেম্বর-জুনের ডেডলাইন থেকে সরছে না কেন-এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে সবাই। সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের শুরুর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত আবেগঘন কথা বলেছেন। গত সোমবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পর্বের প্রথম বৈঠকে ২৬টি দল অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ২৩টিই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তাহলে জাপান সফরে প্রধান উপদেষ্টা কেন বললেন, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়! তিনি কি তাহলে বিএনপিকে কোনো কারণে চাপে রাখতে চাচ্ছেন? তিনি কি নিজের অজান্তে অথবা জ্ঞাতসারে বিএনপিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন? বিএনপি যদি তার প্রতিপক্ষ হয়, তাহলে তিনি কোন পক্ষের? তার আচরণ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তার শারীরিক উচ্চতার চেয়ে সম্মানের উচ্চতা অনেক অনেক বেশি। তিনি কেন, কোন স্বার্থে একটি অসত্য তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করলেন তা প্রথম প্রথম অনেকের বোধগম্য না হলেও, যত সময় যাচ্ছে বিষয়টি তত স্পষ্ট হচ্ছে। আরেকটি বিষয়ও দেশবাসীর কাছে দিনদিন স্পষ্ট হচ্ছে, সেটা হলো নির্বাচনের রোডম্যাপ ‘ডিসেম্বর-জুন’ থেকে তিনি সরছেন না কেন। যত আলোচনাই হোক, সংস্কার নিয়ে যত সময়ক্ষেপণই হোক না কেন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলছে না। রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেন, তিনি যাদের আশীর্বাদপুষ্ট আগামী সংসদ নির্বাচনে তাদের হিস্সা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হিসাব মিলবে না। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে গত সোমবারের আলোচনার পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘জুলাই সনদ হওয়ার পরেই আমরা চাই সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুক। সে সময়ই আমরা আমাদের দলের অবস্থান স্পষ্ট করব, আমরা কখন নির্বাচন চাই। ’ সুতরাং প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে তার বিশাল প্রাপ্তির ঋণ শোধ করবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমার শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন দেশবাসীর হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো অবস্থা হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এতদিন পর একজন উপযুক্ত কান্ডারি দেশের স্টিয়ারিং ধরেছেন। এত খুন, এত রক্ত, এত অঙ্গহানি, এত সম্পদহানির বিভীষিকার মধ্যেও দেশবাসী নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আমাদের এক ইউনূস আছেন, ইনশা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে-এমন প্রত্যাশা ছিল প্রতিটি নাগরিকের। কিন্তু গত ১০ মাসে প্রত্যাশার অমূল্য কাচে চিড় ধরতে শুরু করেছে। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি অপছন্দের লোক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে ছিলেন চরম খারাপ মানুষ। সেজন্যই একজন নোবেল লরিয়েটকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না। সুদখোর, লোভী ইত্যাদি অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করে অপমান করা হতো। কিন্তু ১০ মাসে সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তাকে অপছন্দ করার লোকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এর জন্য প্রধান উপদেষ্টা একা দায়ী নন। রাষ্ট্রটাকে মেরামত ও চালানোর জন্য তিনি যাদের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই বর্তমান সময়ের জন্য উপযোগী নন। বিশেষ করে আমরা যদি ১৯৯০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক মর্যাদা পর্যালোচনা করি, তাহলে বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অনেকের ইমেজই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও একবার উপদেষ্টা ছিলেন। সে সময় তার যারা সহকর্মী ছিলেন আর এখন যারা তার সহকর্মী হয়েছেন, তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদার পার্থক্যও অনেক। বর্তমান উপদেষ্টাদের কার্যক্রম, কথাবার্তা, আচার-আচরণ দেখে অনেকে হতাশ। অনেকেই বলছেন, এনজিও চালানো আর রাষ্ট্র চালানো এক নয়। তবে এটাও খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন এসব উপদেষ্টার কর্মকাণ্ড দেশবাসী জানতে পারবে।
১০ মাসের সরকার একটি বাজেট প্রস্তাব করেছে। এ সময়ের মধ্যে একটি বাজেট তৈরি করতে পারাটাও একটা বড় কর্মযজ্ঞ। বাজেট নিয়ে বরাবরের মতোই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে এবং হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এ বাজেটের মধ্যে বৈষম্য দূর করার মতো কোনো উপাদান নেই। যে বৈষম্যের জন্য রক্ত ঝরল, সে বৈষম্য তো আগের মতোই রয়ে গেল। সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রধান তিনটি খাত হলো বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং বেসরকারি খাত। বাজেটে এ তিন খাতই অবহেলিত রয়ে গেল। গত ১০ মাসে দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎসংকটসহ নানান কারণে দেশি শিল্প বিপাকে আছে। একের পর এক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেকারত্ব বেড়েছে। দেশি বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে চাপে রেখে বিদেশি বিনিয়োগ আনার নানান চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে দুটি সম্মেলন হলো। কিন্তু এখনো সবকিছু কথামালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশি বিনিয়োগকারীদের গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে বিদেশিদের জন্য দরজা খুলে দিলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ সরকার যতই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশন দিয়ে বিদেশিদের বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন, দেশি বিনিয়োগকারীরা কতটা নিরাপদে আছেন তা না দেখে বিদেশিরা বিনিয়োগ করবেন না। আর বিনিয়োগের পরিবেশ সুস্থ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। অথচ জুলাই বিপ্লবের সূচনা ছিল বৈষম্যমুক্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দাবিতে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো বিশ্বব্যাপী ‘থ্রি জিরোস’ বা ‘তিন শূন্য’। তার এ তিন শূন্যের মূল কথা হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ। এ তিন শূন্যতত্ত্ব কার্যকরের জন্য তিনি তার সরকারের বাজেটে তেমন গুরুত্ব দেননি।
ঈদ সবার জন্য অনাবিল আনন্দ বয়ে আনুক সেটাই সবার কাম্য। পাশাপাশি এও সবার কাম্য হওয়া উচিত যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাপ্তি, লোভলালসার জন্য যেন রাষ্ট্র বা দেশবাসী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। লোভ ও ক্ষমতার চেয়ে অবিতর্কিত ইমেজ ও সম্মান অনেক বড়।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
manju209@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন