ঢাকা, রবিবার, ২৯ চৈত্র ১৪৩১, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উন্নতির নানা রূপ ও ভিতরের কারণ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৫
উন্নতির নানা রূপ ও ভিতরের কারণ

উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছে বা বনভূমি উজাড় করে দিচ্ছে শুধু তা-ই নয়, নাগরিকদের সুখও কেড়ে নিচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জন। খবর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের। এ হিসাব সঠিক নয় বলে কেউ কেউ বলেন, তাঁদের বক্তব্য প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি, সব ঘটনা খবরে আসে না।

আশাবাদী হওয়াটা খুবই দরকার, আশাবাদী হতে যারা আগ্রহী করছে তারা উন্নতির বিষয়ে নিশ্চিন্তবোধ করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে, দেশে বড় একটা ভোক্তা শ্রেণির উত্থান ঘটেছে। তাতে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়েছে। আর পণ্যের চাহিদা বাড়া মানেই তো উৎপাদন বাড়া। কিন্তু তাই কী? দুয়ে দুয়ে চার? নির্ভুল অঙ্ক? যদি তেমনটাই ঘটত তবে আমাদের জন্য আনন্দের অবধি থাকত না। কারণ, উৎপাদন বাড়া মানেই তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু সেটা কী ঘটছে? বিদেশি পণ্যে কী বাজার ছেয়ে যায়নি? যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদক কোম্পানির অনেকগুলোর মালিকানা ইতোমধ্যেই কি বিদেশিদের হাতে চলে যায়নি? অন্যরাও কি যাওয়ার পথে উন্মুখ হয়ে নেই? সর্বোপরি উৎপাদন, এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফাটা যাচ্ছে কোথায়? বড় একটা অংশই তো পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

শিল্পোদ্যোক্তাদের একজনকে জানি, ব্যক্তিগতভাবে যিনি অত্যন্ত সজ্জন, পাচারে বিশ্বাসী নন; তিনি একটি বই লিখেছেন, যাতে দেশের যে উন্নতি হচ্ছে তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধির। একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের হার অতি শিগগিরই ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। হয়তো তাই ঘটবে। কিন্তু এ উত্থানে উৎফুল্ল হব বুকের এমন পাটা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। কারণ, এ উন্নতির অর্থ দাঁড়াবে একদিকে দেশের সম্পদ পাচার হওয়া অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ তো বটেই, এমনকি সন্তানদেরও দেশে রাখছে না; ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষার জন্য বিদেশে গমনার্থীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটি পত্রিকা জানাচ্ছে গত ১০ বছরে ওই স্রোত দ্বিগুণ পরিমাণে স্ফীত ও বেগবান হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের জানা আছে যে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসা ক্রমাগত কমছে।

নির্মম সত্যটা হলো, যতই উন্নতি ঘটছে ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে, এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশির ভাগই দেশে থাকে। পরিশ্রম করে। এবং তাদের শ্রমের ফলেই দেশের যেটুকু উন্নতি তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবনযাপন করে, ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এ আশাতে যে দেশে তাদের আপনজনরা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে। বিত্তবানরা যা ছড়ায় তাহলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সম্পদ পাচার উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছেকরার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার সংকট চলছে, এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বিত্তবানদের কাজ। তারাই হতাশা সৃষ্টি করে এবং দেশের ভবিষ্যৎহীনতার বিশ্বাস ক্রমাগত বলীয়ান হতে থাকে। এবং নিজেদের ওই হতাশা তারা যে কেবল নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখে তা নয়, অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত করে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হতাশা হচ্ছে একটি রোগ, শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে। একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিবা-রাত সন্ত্রস্ত থাকতাম তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও আমরা কিন্তু হতাশ হইনি; কারণ আমরা জানতাম আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ১৬ ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙার লক্ষণ দেখা দিয়েছে; এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা।

এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এ কারণে যে, উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির। এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম, বাহাত্তরে দেখা গেল সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে। এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে এ বাংলাদেশে। দেখা গেছে পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী, এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে তবে আগেরবারের তুলনায় পরেরবার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম সবার মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।

দেশের মানুষ বিদেশে শিক্ষার জন্য যেমন যায়, তেমনি যায় চিকিৎসার জন্যও। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসকের কি অভাব আছে? আধুনিক যন্ত্রপাতি কি নেই? আকাল পড়েছে কি চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞানের? না, অভাব এসবের কোনো কিছুরই নয়। অভাব ঘটেছে একটা জিনিসেরই, সেটা হলো আস্থা। রোগী আস্থা রাখতে অসমর্থ হয় দেশি চিকিৎসকের চিকিৎসায়। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা পারলে সিঙ্গাপুরে বা ব্যাংককে যায়, অত খরচে যারা অপারগ তারা চেষ্টা করে ভারতে যাওয়ার। এবং হতাশা যেমন, অনাস্থাও তেমনি- ভীষণ রকমের সংক্রামক।

আস্থার এ অভাবের কারণটা কী? কারণ হচ্ছে দেশি চিকিৎসকদের অধিকাংশই রোগীকে সময় দিতে পারেন না, পর্যাপ্ত মনোযোগ দানেও ব্যর্থ হন। না দিতে পারার কারণ তাঁদের তাড়া করার জন্য ঘাড়ের ওপর বসে থাকে অর্থোপাজনের নিষ্ঠুর তাগিদ। যত বেশি রোগী দেখবেন তত বেশি আয় হবে। রোগ সারানোর জন্য খ্যাত হওয়ার চেয়ে আগ্রহটা থাকে অপরের তুলনায় অধিক আয় করার দিকে। আমাদের নতুন স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও দেখলাম আস্থার এ অভাবের কথাটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু আস্থা কীভাবে ফেরত আনা যাবে তা যে তিনি জানেন এমনটা ভরসা করা কঠিন। আর জানলেও তা কার্যকর করার উপায় তাঁর হাতে না থাকারই কথা। কারণ ব্যাপারটা একজন-দুজন চিকিৎসকের নয়, ব্যাপারটা এমনকি চিকিৎসাব্যবস্থাতেও সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থাজুড়ে। সর্বত্রই আস্থাহীনতা বিরাজমান।

ভারতের পরিবর্তে চীনে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের আলোচনা চলছে। বণিক চীন নাকি বিত্তবান বাংলাদেশিদের জন্য নিজ দেশে এবং বাংলাদেশেও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দেনদরবার করছে, সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে। অথচ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একমাত্র চিকিৎসার আশ্রয় সরকারি হাসপাতালগুলোর উন্নয়নে অতীতের সরকারের ন্যায় বর্তমান সরকারও উদাসীন। গরিবের পক্ষে থাকার সরকার দেশবাসী আজও পায়নি, তাই।

শুরুটা কিন্তু দেশের ভবিষ্যতের প্রতি আস্থার অভাব দিয়েই। সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা মনে করে যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই অন্যত্র বসতি গড়তে পারলে ভালো। সেই চেষ্টাই তারা করতে থাকে। এবং চেষ্টার অংশ হিসেবে বৈধ-অবৈধ যে পথেই সম্ভব টাকাপয়সা যা সংগ্রহ করতে পারে তা পাচার করার পথ খোঁজে। তাদের এ আস্থাহীনতা অন্যদের মধ্যেও অতিসহজেই সংক্রমিত হয়ে যায়। এবং সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছেও। কিন্তু আশা জাগানিয়ার পথ ক্রমাগত রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৫
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।