১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয় ছিলো মাত্র ৩৭ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অংকটা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৭৯ কোটি ৯৩ লাখ মার্কিন ডলারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশ ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ শুরু করে। এই সময় মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার মজুদ করে। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৪১৪ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
১৯৮১ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিলো ৮৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন। এখন জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫১ দশমিক ৭ মিলিয়নে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্যে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।
বর্ধিত জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে মাত্র ১৫ কোটি টাকা বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ৬৮ কোটি টাকায়।
অন্যান্য সূচকেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ও। ১৯৮১ সালে গড় আয়ু ছিলো ৫৪ বছর ৮ মাস। এখন তা ৭১ বছর ছয় মাস।
১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের থাবা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হবার পর এখন বহুমাত্রিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শুরুতেযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো। এর মধ্যে দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছেও। হয়ে গেছে নানা আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্য-সূচকে রোল মডেল। বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল (ডেভেলপিং) দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্রও পেয়ে গেছে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক কমিটি ১৬ মার্চ শুক্রবার রাতে নিউইয়র্কে বৈঠকে নিশ্চিত করে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের সব সূচক প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে।
এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা থেকে উত্তরণের সূচক এ তিনটির যে কোনো দু’টি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ এ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) এর মানদণ্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪.৮ ভাগ।
রেকর্ড জিডিপি-মাথাপিছু আয়ঃ অন্যদিকে সকল বৃত্ত ভেঙে রেকর্ড পরিমাণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ফলে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি বেড়ে জিডিপি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর দেশবাসীর মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা।
এর ফলে জিডিপি’র আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশ স্বাধীনের পর জিডিপি’র আকার ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াতে যেখানে সময় লেগেছিল ৩৪ বছর, সেখানে এ অর্জন রেকর্ড পরিমাণ।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
তবে স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি বাড়েনি। এর মধ্যে ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। এরপর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে ৬ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপির আকার ২৪ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। জিডিপির আকার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াতে স্বাধীনতার পর ৩৪ বছর লেগেছে। উন্নতি হয়েছে মাথাপিছু আয়েও। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা বা ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার।
এই প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় উঠেছিলাম। সেখানে ৪৩ বছর পর আমরা উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলাম। হয়তো এ অবস্থায় আসতে অন্যসব দেশের তুলনায় আমাদের সময় বেশি লেগেছে। কিন্তু এখন আমরা খুব দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করবো। শুধু উন্নয়নশীলই নয়, উন্নত দেশ হবে বাংলাদেশ।
তিনি মন্ত্রী আরো বলেন, জনসংখ্যা বাংলাদেশের সম্পদ। কর্মক্ষম এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো। আমাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না । বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশ হবে। চীন, ভারত ও জাপান আমাদের ফেলে উন্নতি করতে পারবে না। বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে সবাইকে উন্নয়ন করতে হবে। এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়াতে আমাদের বড় কোনো আর্থিক ক্ষতি হবে না। রপ্তানিও কমবে না বরং বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে। চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আগের শর্তেই ঋণ পাওয়া যাবে। বড় অংকের ঋণের জন্য দরকষাকষি করা যাবে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এটি আমাদের নতুন ইতিহাস। ২০১৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে যাবে। আশা করছি, ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকবে। তাহলেই আমরা আমাদের ২০৪১ সালের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো। বিশ্ব এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে অবাক হয়। বিশ্বে স্বল্প সময়ে উন্নয়নের এক রোল মডেল এখন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
এমআইএস/জেএম