ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকের অবদান উপেক্ষিত

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০৭, মার্চ ২৫, ২০১৮
মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকের অবদান উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে লন্ডনে বাঙালি কূটনীতিকদের সমাবেশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: বঙ্গবন্ধু আহ্বানে দেশের সব পেশার জনগণের মত স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি কূটনীতিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের অবদান সারা দেশ, জাতি স্মরণ করবে এমনই আশা করি।

এমন গুটিকয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মানিত হয়েছেন, পদক পেয়েছেন। তবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকদের অনেকের অবদান আজো রয়ে গেছে  উপেক্ষিত ।

এমনটাই জানালেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান।

বাংলানিউজকে তিনি সখেদে বললেন, আমাদেরতো স্বীকৃতিই দেওয়া হয় না। আমরা কোনো মূল্যায়ন চাই না। পুরস্কার চাই না। যারা যুদ্ধ করেছে তাদের যেভাবে দেওয়া হয়েছে স্বীকৃতি, ঠিক সেভাবে যেন আমাদেরও দেয়া হয়—এটুকুই শুধু চাওয়া।
কিন্তু আজ আমরা মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকদের অনেকেই রয়ে গেছি স্বীকৃতিহীন, উপেক্ষিত। জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে ডাক আমরা তেমন একটা পাই না।  

উন্নয়নশীল দেশের  যোগ্যতার উত্তরণে  সারাদেশে উৎসব হল। দুঃখের বিষয়, ২২ মার্চ  এ নিয়ে অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকদের ডাকাই হয়নি।

বাঙালি কূটনীতিকদের প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের ১৩৫টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্য তাদের বড় রোল (ভূমিকা) ছিল।

ওয়ালিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের ন’মাসে বাঙালি কূটনীতিকদের একেকজন একেক সময়ে ‘ডিফেকশন' বা দলত্যাগ করেছেন। আর এটা হয়েছে মুজিবনগর সরকারের নির্দেশেই। আমি ৭১ নভেম্বরে জেনেভায় মিশন থেকে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। এমনটাই নির্দেশ ছিল। আমি এ সময়ে পুরো  ইউরোপ চষে বেড়িয়েছি বাংলাদেশের পক্ষে।

তিনি বলেন, বিদেশে আমাদের দেশি লোক সবচেয়ে বেশি বসবাস করতো যুক্তরাজ্যে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী  জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে মিটিং করার পর লন্ডনে ফিরে এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দিলেন। তাকে মুজিবনগর সরকার 'অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ' হিসেবে নিয়োগ দিল। লন্ডনে দূতাবাসের প্রথম যে কূটনীতিক বের হয়ে এলেন, তিনি দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হলো ১৭ আগস্ট। আরও তিন কূটনীতিক হাবিবুর রহমান, লুৎফুল মতিন ও ফজলুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিলেন। পরে সিনিয়র কূটনীতিক কাউন্সিলর রেজাউল করীম বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিলেন।

ওয়ালিউর রহমান বলেন, কিন্তু ভারতের বাইরে সবচেয়ে বড় দল বেঁধে 'ডিফেকশন' (পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগের ঘটনা) হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে একযোগে ১৪ জন কূটনীতিক ও স্টাফ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন ৪ আগস্ট, ১৯৭১। এই দলটির নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আনোয়ারুল করীম। তখন তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের উপ-প্রধান প্রতিনিধি ও মিনিস্টার। দলে ছিলেন এনায়েত করীম। তিনি ছিলেন মিনিস্টার, ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের উপ-মিশন প্রধান। সাবেক অর্থমন্ত্রী কাউন্সিলর শাহ এমএস কিবরিয়া, বর্তমান অর্থমন্ত্রী অর্থনৈতিক কাউন্সিলর আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষাবিষয়ক কাউন্সিলর সৈয়দ আবুল রশীদ মতীন উদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব (হিসাব বিভাগ) আতাউর রহমান চৌধুরী ও বর্তমানে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তৃতীয় সচিব (রাজনৈতিক) সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তিনজন স্থানীয়ভিত্তিক কর্মকর্তা শরফুল আলম, শেখ রুস্তম আলী ও আবদুর রাজ্জাক খানও এ দলে যোগ দেন।

নিউইয়র্কে সৈয়দ আনোয়ারুল কবীর ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস কনসাল মাহমুদ আলীকে নিয়ে মিশন গঠিত হলো। রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেন ইরাকের রাজধানী বাগদাদে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফাতেহ। পরে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী ও আর্জেন্টিনায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন যোগ দিলেন।

মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে যে দুজন কূটনীতিক বাংলাদেশের পক্ষে সর্বপ্রথম আনুগত্য প্রকাশ করেন, তারা হচ্ছেন নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কে এম সাহাবউদ্দিন ও সহকারী প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হক। তারা এ ঘোষণা দিলেন এপ্রিল মাসে।

নভেম্বরে কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও অন্যসব স্টাফও আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু ভারতে আমাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। ১৮ এপ্রিল '৭১ অর্থাৎ সরকার গঠনের একদিন পর কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ হোসেন আলী এবং সব বাঙালি কূটনীতিক ও স্টাফ একযোগে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশের ঘোষণা দেন। রাতারাতি সেখানে স্থাপিত হলো বাংলাদেশ মিশন।

পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওঠালেন হোসেন আলী। তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অন্য কর্মকর্তা যারা তাকে সহযোগিতা করেন তারা হলেন প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম, তৃতীয় সচিবদ্বয় আনোয়ারুল করীম চৌধুরী ও কাজী নজরুল ইসলাম এবং সহকারী প্রেস সচিব মকসুদ আলী।

অন্য কূটনীতিকদের মধ্যে কায়রোর দ্বিতীয় সচিব ফজলুল করীম, লাগোসে নিযুক্ত তৃতীয় সচিব মহীউদ্দিন জায়গীরদার, তিউনিসিয়ায় নিযুক্ত তৃতীয় সচিব সৈয়দ আমীরুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে লন্ডন মিশনে যোগদান করেন।

পরে নেপালের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, টোকিওর প্রেস কাউন্সিলর এসএম মাসুদ ও তৃতীয় সচিব কমর রহীম, হংকংয়ের ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য মিশন প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ যোগ দেন। তারা যে যে দেশে অবস্থান করছেন, তাদেরকে সেসব দেশের রাজধানীতে মিশন খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ সকল কূটনীতিকের এই বিশেষ অবদান ভোলার নয়। তারা বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করেছেন করেছেন।

রাষ্ট্র আর কিছু না হোক, তাদের অবদানের ন্যূনতম স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মানটুকু দিক। রাষ্ট্রের কাছে এটুকুই কেবল প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
কেজেড/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।