ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

২৫ মার্চের প্রথম প্রতিরোধ

থ্রি নট থ্রি’র সাড়ে তিন ঘণ্টা!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪১, মার্চ ২৫, ২০১৮
থ্রি নট থ্রি’র সাড়ে তিন ঘণ্টা! ২৫ মার্চের প্রথম প্রতিরোধ

ঢাকা: ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর আচমকা অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সদস্যরাও ছিল সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অন্যতম টার্গেট। অতর্কিত হামলায় পিছু না হটে ‘থ্রি নট থ্রি’ ও ‘মার্ক ফোর’ রাইফেল হাতে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরাই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রতিরোধযোদ্ধা ও পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু শামা শুনিয়েছেন ভয়াল সেই কালো রাতের কথা। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তুলে ধরেন হায়েনার মতো হামলে পড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের অপ্রতিরোধ্য সেই সাড়ে তিন ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর বয়ান।

সেসময়ে কনস্টেবল আবু শামা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন। ডিউটিতে যাওয়ার আগে কনস্টেবলদের অস্ত্র সরবরাহ এবং ডিউটি শেষে অস্ত্র জমা নেওয়ার কাজ করতেন তিনি।
 
তিনি বলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পরই বিভিন্ন সোর্স এবং গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সংবাদ আসছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে টার্গেট করেছে। তারা যে কোনো সময় আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। কারণ এখানকার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল বাঙালি। আমরাও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ হৃদয়ে ধারণ করে নিজেদের মধ্যে একটা প্রস্তুতি নিতে থাকি।
 
রাত ৯টার দিকে আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি। ওয়ারলেসে খবর আসে পাকিস্তানিরা সুসজ্জিতভাবে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে এদিকে অগ্রসর হচ্ছে। পরক্ষণে দেখি, অস্ত্রাগারে তালা মারা।
 
তাৎক্ষণিকভাবে আমরা কয়েকজন আরআই সাহেবের বাসায় চলে যাই। গিয়ে দেখি তিনি পরিবার নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। তার কাছে অস্ত্রাগারের চাবি চাইলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। এরপর জোরপূর্বক চাবি আদায় করে রাজারবাগে ফিরে আসি। ওই চাবি দিয়ে একটি অস্ত্রাগার খুলে ফেলি। আরেকটি অস্ত্রাগার খুলতে না পারায় শাবল দিয়ে তালা ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
 
তিনি বলেন, পাগলা ঘণ্টি বাজানোর পর সবাই দৌড়ে এসে অস্ত্র এবং গুলি নিচ্ছিল। তখন আমরা প্রত্যেকের জন্য ২০ রাউন্ড করে গুলি ইস্যু করেছিলাম। আর অস্ত্র বলতে শুধু ‘মার্ক ফোর’ আর ‘থ্রি নট থ্রি রাইফেল। কেউ গামছা বেঁধে কেউ পকেটে ভরে, কেউ লুঙ্গিতে করে গুলি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিল।
 
রাত সাড়ে ১১টায় রাজারবাগে পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু হয়। এরপর প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা আমাদের সঙ্গে তুমুল বেগে লড়াই চলে। তারা আমাদের উপরে যুদ্ধবিমান ছাড়া রকেট লঞ্চার, কামান, হেভি মেশিনগান, ট্যাংসহ যাবতীয় সকল ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু প্রায় ৫ শতাধিক পুলিশ সদস্যের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজারবাগের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।
 
ভোরে আজানের পর ট্যাংকের সাহায্যে রাজারবাগের ১ ও ২ নম্বর গেট ভেঙ্গে ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ট্যাংকের পেছনে ৯-১০টি ট্রাক ছিল। সেদিন প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত ১৫০ পুলিশ সদস্যের মরদেহ সেসব ট্রাকে তোলা হচ্ছিল। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় তখন টেলিফোন অপারেটর শাহজাহান ও মনির, কনস্টেবল গিয়াসউদ্দিন ও আব্দুল হালিমসহ আমরা কয়েকজন চারতলা ভবনের ছাদে পানির ট্যাংকির নিচে আশ্রয় নেই। সেখান থেকে আমরা সবকিছু দেখছিলাম।
 
ওরা জীবিত যাদের পাচ্ছিল তাদেরকে চরম নির্যাতন করছিল। পাকিস্তানি খুনে হানাদার সেনারা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে বের করল। তারপর বুটের লাথি, চাইনিজ রাইফেলের বাটের বাড়ি, বেয়নেটের খোঁচায় আমাদের সমস্ত দেহ রক্তাক্ত হয়ে গেল। টেনে হিঁচড়ে নিচে নামানোর পর সব মিলে আমাদের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে বেধড়ক পেটাচ্ছিল।
 
সে সময়ের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, দেখলাম আমাদের ক্যান্টিনবয় আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় পাশের একটি ড্রেনে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে হানাদার পাকিস্তানি এক সৈন্য উঠিয়ে এনে আছাড় মারতে লাগল। ছেলেটা ‘পানি, পানি’ বলে শব্দ করুণ আকুতি জানাচ্ছিল। তখন এক পাকি সেনা ওই মৃতপ্রায় বাচ্চাটার মুখে প্রস্রাব করে দিল। চোখের সামনে এটা দেখে সহ্য করা খুবই কষ্টদায়ক ছিল।
 
এরপর সবাইকে তিনদিন ধরে মিল ব্যারাকে খাবার-পানি ছাড়া বন্দি করে রাখা হলো। ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার এসে তার জিম্মায় আমাদেরকে মুক্ত করে নীল ব্যারাকে পাঠালেন। তখনই আমরা কয়েকজন সঙ্গী নীল ব্যারাকে না গিয়ে গেন্ডারিয়া স্টেশনে চলে গেলাম।
 
সূত্রাপুর লোহারপুল এলাকায় গিয়ে দেখি ব্রিজের দুইপাশে লাশের স্তূপ পড়ে আছে। গেন্ডারিয়া রেল স্টেশনের কাছে গেলে কয়েকজন ছাত্র-জনতা আমাদের কাছে এগিয়ে আসে। রক্তাক্ত পুলিশ ড্রেস পরনে দেখে তারা আমাদের পরিচয় জানতে চায়। তারপর ওরা কাঁধে উঠায়ে আমাদেরকে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। পানি গরম করে ডেটল দিয়ে গোসল করায়, পাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, ভাত তরকারী এনে দেয়। প্রায় তিনদিন পর আমরা একটু ভাত খেলাম।
 
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবু শামা বলেন, সেদিন তারা খুব আদর–সোহাগ করছে। এদের কথা আমরা ভুলতে পারি না। এখনো মাঝে মাঝে স্মৃতি হয়ে মনে উঁকি দেয় তাদের মুখ।
 
এরপর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। তখন এলাকায় একটা কথা রটিয়ে পড়ে, রাজারবাগের কোনো ফোর্স জীবিত নাই। আমাকে দেখে গ্রামের সবাই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। মনে একটাই আনন্দ ছিল, ‘আমি জীবিত আছি। ’
 
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়া আবু শামা এতেই ক্ষান্ত হননি। ক্যাপ্টেন নুরুল আজিম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন নম্বর সেক্টরে যোগদান করে আবারো সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। অক্টোবরের শেষের দিকে একটি সম্মুখযুদ্ধে বুকের ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহন হন। সহযোদ্ধাদের কেউ ভাবেননি আবু শামা বাঁচবেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়ায় তিনি বেঁচে ফেরেন।
 
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা ১৯৯৮ সালে পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থানার পীরপুরের নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন।

আবু শামা জানান, যুদ্ধের সময় তার বাড়ি তিনবার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তার বাবাকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। কারো কাছেই কোনোদিন কিছু চাননি। কষ্ট করে বড় ছেলেকে এমবিএ করিয়েছেন ও এক মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আরো এক ছেলে তিন মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
 
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্থান পেলেও পেনশন ছাড়া অন্য কোনো ভাতা পাননি তিনি। তারপরেও খুব বেশি চাওয়া নেই জাতির এই বীর সন্তানের। কিডনির রোগে আক্রান্ত আবু শামার রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।

তিনি বলেন, এ সময়ে কোন পদবিও চাই না, দয়াও চাইনা। আমি চাই যতোদিন বেঁচে আছি, ততোদিন যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে হয়তো আর কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারব।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
পিএম/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।