ঢাকা: অস্বস্তিতে সাভার আশুলিয়ার আন্ডারওয়ার্ল্ড। বিরোধী দল থেকে ক্ষমতাসীন দল।
যুবদলের নেতা থেকে যুবলীগের স্বঘোষিত নেতা। নয়ন থেকে রাসেল। চলতি মাসেই দুইজনের অভিন্ন পরিণতিতে আতঙ্ক আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ভেতরে বাইরে। নয়নের পর রাসেল। তালিকায় এরপর কে? সেই প্রশ্নই এখন ঘুরে-ফিরে সবার মুখে।
এই আতঙ্কের নাম শাহ মিজান শাফিউর রহমান। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার। সন্ত্রাসের জনপদ লক্ষ্মীপুরের এসপির দায়িত্ব পালন করে সেখানে ছড়িয়েছেন শান্তির সুবাতাস। সে কথা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে লক্ষীপুরবাসী।
ঢাকায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব নিয়েই আগে বসেন পর্যালোচনায়। কারা অশান্ত করছে ঢাকাকে। ভালো মানুষের বেশে কারা করছে মাদকব্যবসা, জমি দখল কিংবা চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। তারপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের কপালে জুটছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু।
গত ১ অক্টোবর সাভারে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ-আলম নয়ন (৪২)। গভীর রাতে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কৃষিবিদ নার্সারির পাশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান তিনি। নয়ন ছিলেন পৌর এলাকার মালঞ্চ আবাসিক এলাকার শহিদুল ইসলামের ছেলে। তার বিরুদ্ধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান এবং অপহরণ-হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা ছিলো সাভার, ধামরাই ও মানিকগঞ্জ থানায়।
একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছিলো তার। এই নয়নের অত্যাচারে সাভারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ রোববার ভোরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেল দেওয়ান (৪২)। তিনি আশুলিয়ার নিরিবিলি এলাকার পিয়ার আলীর ছেলে।
সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, মাদক, জমিদখল, হেন কাজ নেই যেখানে রাসেল ও তার বাহিনী নেই। আবার রাজনীতির মাঠেও রাসেল। যে কারণে অভিযোগকারীরাও হতেন বিভ্রান্ত। কার কাছে অভিযোগ করবেন। ফলাফল কী হবে? উল্টো অভিযোগ করার পরিণতি নিয়েই নতুন ভাবনায় জড়াতে হতো সাধারণ মানুষকে।
রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত হলেও নিজেকে যুবলীগের নেতা পরিচয় দিতেন রাসেল। প্রচারণায় দেখা যায়, বিভিন্ন নেতার পক্ষে ‘সৌজন্যে রাসেল দেওয়ান, আশুলিয়া যুবলীগ’। এভাবেই রাজনীতিতেও সরব ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক রাসেল। কিন্তু বিধিবাম। রাসেলের পরিবারের দাবী- দিন তিনেক আগে পুলিশ পরিচয়ে কে বা কারা তাকে তুলে নেয়।
রোববার সকালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাসেলের মৃত্যুর খবর আসে তার পরিবারের কাছে। আশুলিয়া থানার ওসি মহসীন কাদের বাংলানিউজকে বলেছেন, রাসেলের বিরুদ্ধে হত্যা, চাদাঁবাজি, মাদকসহ ১৪টি মামলা রয়েছে। তিনি তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। রাসেলকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধার ও সহযোগীদের গ্রেফতারে ভোরে আশুলিয়ায় কুড়গাঁও গ্রামে অভিযানে যায় পুলিশ।
সেখানে ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা রাসেলকে ছাড়িয়ে নিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে গুলিবিদ্ধ হন রাসেল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
রাসেলের মাথা বরাবর গুলি লাগায় সেখান থেকে ঝরা রক্তেই ভিজে যাচ্ছিলো চুল। ভেজেনি কেবল তাদের হৃদয়, যাদের হয়ে রাজনীতির মাঠ কাঁপাতো। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, হত্যাসহ ১৪ মামলার আসামি রাসেল। নেতাদের ড্রইং রুমে রাসেল। ফুলের মালা নিয়ে নেতা বরণেও রাসেল। জমিদখল থেকে যে কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা বা মাদক কিংবা ঝুট ব্যবসার ক্ষেত্রেও রাসেল। তাকে নিয়ে কীভাবে নেতারা এতদিন ‘রাজনীতি’ করলেন সেটারও জবাব মিলছে না কারো কাছে।
রাসেল দলের কেউ নন। তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে তকমা দিচ্ছেন দলীয় নেতারা। কিন্তু পোস্টার কিংবা ব্যানারে নেতাদের সৌজন্যে দেওয়া রাসেলের ছবিগুলো এখন কেবলই উপহাস করছে। স্বাক্ষ্য দিচ্ছে- রাজনীতি আর সন্ত্রাসের পিঠাপিঠি ভাই হিসেবে।
সাভার আশুলিয়ার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের হিসেবটাও ওলটপালট হতে থাকে চলতি বছরের ২০ জুলাইয়ের পর। ঢাকার এসপি হিসেবে ২০তম ব্যাচের শাহ মিজান শাফিউর রহমান যোগদানের পরপরই তিনি নানা হুঁশিয়ারি ও পদক্ষেপের বার্তা পৌঁছে দেন সন্ত্রাসীদের ডেরায়। শাহ মিজান শাফিউর রহমান যোগদানের পরপরই মুখোমুখি হন বাংলানিউজের।
তার প্রথম বার্তাটাই ছিলো- ‘আমি নিজে দুর্নীতিকে ঘৃণা করি। অপছন্দ করি দুর্নীতিবাজদের। সন্ত্রাস নিয়ে আমার জিরো টলারেন্স। কারণ সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই, থাকতে পারেও না। সন্ত্রাসীরাই নিজেদের বাঁচাতে রাজনীতির ঠাঁই নেয়। ’ সেই বার্তাটাই এখন গোটা জেলার থানায়-থানায়।
ঊধ্বর্তন একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, এটাই শাহ মিজান শাফিউর রহমান। উদাহরণ টেনে বললেন, পুলিশ অপরাধ করলে, পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
তেমনি প্রভাবশালী একজন রাজনীতিবিদের আত্নীয় অপরাধে জড়িয়েছেন। অনেক তদবির এসেছে। তাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। মামলার আসামি হতে হয়েছে।
ওই কর্মকর্তার মতে, ‘অপরাধী বা সন্ত্রাসী। তিনি যতই বড়ই হোক না কেন। বর্তমান রেকর্ড আর অতীত রেকর্ড ধরে ‘রোজনামচা’ লেখা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুত, এখন অপেক্ষা, অপরাধীর শেষ পরিণতি দেখা। ’
এমন পরিস্থিতির কারণে নয়নের পর রাসেল। এরপর তালিকায় কে? এই প্রশ্নেই এখন উত্তাল সাভার আশুলিয়ার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ভেতর-বাহির।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৬
টিআই