ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

‘দেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হওয়া কন্যাশিশুর সংখ্যা অনেক বেশি’

ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২৩, অক্টোবর ১৫, ২০২৫
‘দেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হওয়া কন্যাশিশুর সংখ্যা অনেক বেশি’ বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স: ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেছেন, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়, এমন কন্যাশিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে না পারা কন্যাশিশুর সংখ্যাও অনেক বেশি।

ঘরে সহিংসতার শিকার হওয়া কন্যাশিশুর সংখ্যাও নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি।

বুধবার (১৫ অক্টোবর)  আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২৫ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন।

বিবৃতিতে তিনি বলেন,  বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২৫ পালনে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ বিশেষ সময়ে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি কন্যাশিশুর অসাধারণ শক্তি, নেতৃত্ব ও সাহসকে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সম্মান জানাই। শহরের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যেসব কন্যাশিশু উঠে দাঁড়ায়, কথা বলে, নিজের মতামত তুলে ধরে এবং পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়, এমনকি অকল্পনীয় প্রতিকূলতার মুখেও তারা এগিয়ে চলে–তারা প্রতিদিন আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
 
‘আমি কন্যাশিশু, আমি পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিই: সংকটে সম্মুখভাগে থাকা কন্যাশিশু’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ইউনিসেফ পরিবর্তনের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে কন্যাশিশুদের সম্মান জানাচ্ছে ও দিনটি উদযাপন করছে। এ কন্যাশিশুরা ভুক্তভোগী নয়, বরং স্বপ্নদ্রষ্টা- যারা আরও ভালো একটি আগামী নির্মাণে কাজ করছে। তাদের কণ্ঠস্বর, চিন্তাভাবনা ও নেতৃত্ব শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, বরং তাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি তৈরি করা বহুমুখী সংকট উত্তরণের জন্য অপরিহার্য। এসব সংকটের মধ্যে ক্ষতিকর সামাজিক রীতি-নীতি থেকে শুরু করে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এমন মাত্রার সহিংসতা, দারিদ্র্য ও জলবায়ুজনিত অভিঘাতের মতো বিষয়গুলো রয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিশ্বজুড়ে কিশোরী কন্যাশিশুরা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, প্রায়ই যার পেছনে থাকে সমাজের গভীরে বিদ্যমান বৈষম্য ও দারিদ্র্য। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের অর্ধেকের বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। অগ্রগতি সত্ত্বেও যেমন ১৯৫১ সালে কিশোরী ও তরুণ নারীদের মধ্যে নিরক্ষরতার হার যেখানে ছিল প্রতি ১০ জনে ৪ জন, তা আজ কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি ১০ জনে মাত্র ১ জন) তারপরেও এখনো অনেক কন্যাশিশু বিকশিত হওয়ার এবং স্বপ্ন দেখার ও তা পূরণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে কন্যাশিশুদের অংশগ্রহণ এখনো খুবই কম-মাত্র ১০ থেকে ১৭ শতাংশ। এ বাস্তবতা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল এ ডিজিটাল বিশ্বে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগকে সীমিত করে দিচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিটি পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে একেকজন শিশু, যার স্বপ্ন থেমে গেছে; একজন তরুণী যার সম্ভাবনা বাংলাদেশ হারাতে বসেছে।  জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কন্যাশিশুরা নানাবিধ ঝুঁকির মুখোমুখি হয় যেমন শিশুবিবাহ, অকাল গর্ভধারণ, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত থাকা। এসব চ্যালেঞ্জ শুধু তাদের শৈশব ও আশা কেড়ে নেয় না, অনেক ক্ষেত্রে জীবননাশের ঝুঁকিও তৈরি করে। ঘরে, জনসমক্ষে বা অনলাইনে যেখানেই সহিংসতা হোক না কেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং একটি বড় হুমকি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কিশোরীরা বিশেষ করে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কন্যাশিশুরা শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। এই অদৃশ্য ক্ষত তাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করে এবং ভবিষ্যতের দিগন্ত সংকুচিত করে দেয়। এগুলো শুধু অধিকার লঙ্ঘন নয়, এগুলো শৈশবেরও লঙ্ঘন।

কিশোরী কন্যাশিশুদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য আরেকটি নীরব সংকট এবং গভীর উদ্বেগের জায়গা। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ১২ শতাংশ এবং অবিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ৯ শতাংশের মধ্যে মাঝারি মাত্রার বিষণ্নতার লক্ষণ১ রয়েছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অনেক কন্যাশিশু নীরবে ধুঁকছে এবং তাদের বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা জরুরিভাবে প্রয়োজন। অভিভাবকেরা প্রায়ই কন্যাশিশুদের এই একাকিত্ব ও মানসিক চাপ সম্পর্কে যথেষ্টভাবে অবগত নন। আর অনলাইন বুলিং ও নিপীড়নের কারণে এই সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের অবশ্যই তাদের কথা শুনতে হবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সহমর্মিতা ও যত্ন নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে আর নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা একা নয়।

এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা প্রতিদিন বাংলাদেশের অসংখ্য অনুপ্রেরণাদায়ী কন্যাশিশুর গল্প দেখি, যারা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যেসব কন্যাশিশুরা কমিউনিটির ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, শিক্ষার্থীদের নানা উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং অপর কন্যাশিশুদেরও সমান সুযোগের জন্য সোচ্চার হচ্ছে- তারাই আসল সম্মুখসারির যোদ্ধা। তারা পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে না, তারাই নিজেরাই ‘পরিবর্তন’। তারা সাহস, সহমর্মিতা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে- সমাধান বের করছে এবং দৃঢ়তার উদাহরণ তৈরি করছে। বলিষ্ঠতার এ গল্পগুলো আরও বড় পরিসরে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের অধিকার এগিয়ে নেওয়া এবং তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কী কী পরিবর্তন প্রয়োজন, তা সারা বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা কতটা পরিষ্কারভাবে বোঝে, সেটা এদেশের কিশোরী কন্যাশিশুরা প্রায়ই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। দিশা নামের একটি কন্যাশিশু আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের এক পরামর্শসভায় শিশু সুরক্ষা, সাইবার বুলিং ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনগুলো সম্পর্কে সুচিন্তিতভাবে তার ভাবনা তুলে ধরেছিল। সে উল্লেখ করে যে, তার মতো অনেক কন্যাশিশু এখনো এসব আইন সম্পর্কে জানে না। এসব তথ্য যাতে সবাই সহজে পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দিয়ে বলে দিশা। সে আরও উল্লেখ করে যে, এখন এত বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকায় কন্যাশিশুদের জন্য সরকারি অফিস বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তথ্য পাওয়াটা অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে।

বাংলাদেশে করণীয় সম্পর্কে আমাদের আহ্বান স্পষ্ট: অনুগ্রহ করে কিশোরীদের কণ্ঠস্বরকে আরও উচ্চকিত করুন, তাদের মতামত প্রকাশ করতে দিন এবং তাদের অগ্রাধিকারগুলোকে লক্ষ্যভিত্তিক ও বাস্তব পদক্ষেপে, বাস্তব প্রয়োগে রূপ দিন। সরকার, কমিউনিটি (সমাজ) এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলো সহিংসতামুক্ত নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে আরও কাজ করতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং সেবা দিতে পারে এবং কিশোরীদের সুরক্ষার জন্য যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো শুধু লিখিত নয়, বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারে।

কন্যাশিশুদের নেতৃত্বের বিকাশ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে কন্যাশিশুদের নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোতে রিসোর্স (সম্পদ) সরবরাহ করা প্রয়োজন। কন্যাশিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা, শিখতে এবং বিকাশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে কন্যাশিশুদের এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধাগুলো দূর করা জরুরি।

একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের কিশোরীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখতে ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাবে ইউনিসেফ। আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের এই সপ্তাহে ইউনিসেফ তোমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে, তোমাদের সাফল্য উদযাপন করছে এবং তোমাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে এমন প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা দূর করার অঙ্গীকার করছে।

আসুন, আমরা প্রতিটি কন্যাশিশুর সাহস, তার স্বপ্ন এবং পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তিকে উদযাপন করি। আসুন, আমাদের ভবিষ্যতের নির্মাতাদের জন্য দরজা খুলে দিই এবং নিশ্চিত করি যে তাদের জীবন নিয়ে যেখানে যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার প্রতিটি টেবিলে যেন তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়।
 
টিআর/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।